রাস্তার ছেলে থেকে ‘লৌহমানব’ পুতিন
আন্তর্জাতিক ডেস্ক : ভ্লাদিমির পুতিনের শৈশব ও কৈশোর কেটেছে প্রচণ্ড দারিদ্র্য ও বন্ধুদের উপহাস-তাচ্ছিল্যের মধ্যে। তবে সেই জীবনই তাকে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হওয়ার শক্তি দিয়েছে। ধীরে ধীরে তিনি নিজেকে গড়ে তুলেছেন ইস্পাত-দৃঢ় ব্যক্তি হিসেবে। সোভিয়েত ইউনিয়ন পতনের পর রাশিয়া নতুন করে ঘুরে দাঁড়িয়েছে পুতিনের নেতৃত্বে।
এখনকার দিনের পরাক্রমশালী পুতিনের জীবনের পেছনের অধ্যায় নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম দ্য ডেইলি মিরর। সেটি অবলম্বনে লিখেছেন সঞ্জয় দে।
ভ্লাদিমির পুতিনের প্রথম যুদ্ধটি ছিল একটি ধেড়ে ইঁদুরের বিরুদ্ধে। সেটা সোভিয়েত আমলে অন্ধকার ঘিরে থাকা তার ছেলেবেলায় কথা। জীর্ণ-স্যাঁতসেঁতে অ্যাপার্টমেন্ট ব্লকের বাড়ির করিডরে ইঁদুরটি তাকে আক্রমণ করেছিল।
এখনও সেই গল্পের খুঁটিনাটি টেনে এনে নিজের জয়ের কথা শোনান পুতিন। সম্ভবত তিনি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর ভগ্নদশা এবং দারিদ্র্যকে জয় করে সফল হওয়ার সূত্র জানাতেও গল্পটি ব্যবহার করেন।
২০০০ সালে প্রকাশিত ‘ইন ফার্স্ট পারসন: অ্যান অ্যাস্টোনিশিংলি ফ্র্যাঙ্ক সেলফ-পোর্ট্রেট’ বইয়ে তিনি লিখেছেন, ‘ঘরের সামনের প্রবেশপথেই ছোটাছুটি করত ইঁদুরের দল। আমি এবং আমার বন্ধুরা লাঠি নিয়ে ওদের তাড়া করতাম।
‘একবার আমার চোখে পড়ে বিশালাকার এক ইঁদুর। সেটিকে তাড়া করে হলরুমের এক কোণে নিয়ে যাই। ইঁদুটির পালানোর আর কোনো পথ ছিল না। হঠাৎ সেটি চক্কর খেয়ে আমার দিকে লাফ দেয়। আমি হতভম্ব ও ভয় পেয়ে যাই। ইঁদুরটি এখন পাল্টা আমায় তাড়া করছে!
“সৌভাগ্যক্রমে আমি ওর চেয়ে দ্রুত ছুটছিলাম এবং একদম ওর নাকের ডগায় দরজাটি বন্ধ করতে পেরেছিলাম। সেখানে, সেই সিঁড়ির গোড়ায় আমি সেদিন ‘কোণঠাসা’ শব্দের তাৎক্ষণিক ও প্রকৃত অর্থ শিখে নিতে পেরেছিলাম।”
গল্পটি হয়তো তার সযত্নে লালিত আখ্যানগুলোর অংশ। তবে এটি আমাদের এমন একজন ব্যক্তির গড়ে ওঠার পর্যায়ের আভাস দেয়, যিনি এখন বিশ্বকে একটি রুদ্ধশ্বাস পরিস্থিতিতে (ইউক্রেন ইস্যু) রেখেছেন।
পুতিনের জন্ম ১৯৫২ সালের ৭ অক্টোবর তখনকার লেনিনগ্রাদে। বর্তমানে সেন্ট পিটার্সবার্গ নামে পরিচিত শহরটি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ৯০০ দিন জার্মান বাহিনীর অবরোধের মধ্যে ছিল। অনাহারে প্রাণ হারিয়েছিলেন ১০ লাখের বেশি মানুষ, অনেক পরিবার সম্পূর্ণ নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছিল।
পুতিনের বাবা ছিলেন তার ইউনিটের ২৮ জন পুরুষের মধ্যে মাত্র চারজনের একজন, যারা যুদ্ধ শেষে জীবিত বাড়ি ফিরতে পেরেছিলেন। তবে বেয়নেটের আঘাতের কারণে তার বাকি জীবন অনেকটাই জটিল হয়ে পড়ে।
এই দম্পতির বড় দুই সন্তান অকালেই প্রাণ হারান বলে ধারণা করা হয়। তাদের একজন যুদ্ধের সময় ডিপথেরিয়ায় এবং দ্বিতীয় জন শৈশবকালীন অসুস্থতায় মারা যান।
ভ্লাদিমির পুতিনকে ‘অলৌকিক শিশু’ বলা হয়, কারণ তিনি তার মা-বাবার বেশি বয়সের সন্তান। তার একান্নবর্তী বাড়িটি ছিল দুর্দশাগ্রস্ত, অন্য দুটি পরিবারের সঙ্গে ভাগাভাগি করা বাসায় কেটেছে শৈশব।
পুতিনের সাবেক স্কুলের শিক্ষক ভেরা দিমিত্রিভনা গুরেভিচ বলছেন, ‘বাড়িতে কোনো গরম পানি ছিল না, বাথটাব ছিল না। টয়লেট ছিল ভয়ঙ্কর। বাড়িটি ছিল অত্যন্ত ঠান্ডা ও স্যাঁতসেঁতে।’
পুতিন সে সময় ছিলেন এক ‘রাস্তার ছেলে’। বয়সের তুলনায় ছোটখাটো হওয়ায় উত্যক্তের শিকার হতেন। তবে এসবই তাকে দ্রুত কঠোর হতে শিখিয়েছে।
‘দ্য ম্যান উইদাউট আ ফেস: দ্য আনলাইকলি রাইজ অফ ভ্লাদিমির পুতিন’-এর লেখক মাশা গেসেন বলেন, ‘পুতিনের মা-বাবা ২৪ ঘণ্টা কাজ করতেন। তার মা বিভিন্ন অদক্ষ শ্রমে নিয়োজিত ছিলেন, বাবা কাজ করতেন কারখানায়। তাকে (পুতিন) তার নিজের জগতে ছেড়ে দেয়া হয়েছিল। সে অন্য ছেলেদের সঙ্গে আড্ডাবাজি করত, যেমনটি সব শিশু করে।
এবং মার্শাল আর্টের একটি কৌশল- সামবো আয়ত্ত করার আগ পর্যন্ত প্রায়ই তাকে উত্যক্ত করা হতো। এরপর সে আনুষ্ঠানিক প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে জুডো শিখতে শুরু করে।
পুতিন একটি ব্ল্যাক বেল্টের অধিকারী এবং বিশ্বকে এটি জানতে তিনি পছন্দ করেন। নিজস্ব পরিসরে কেউ কেউ তার ব্যবস্থাপনাকে ‘জুডোক্রেসি’ হিসেবেও উল্লেখ করেন। পুতিন ২০১৫ সালে একবার বলেছিলেন, ‘৫০ বছর আগে লেনিনগ্রাদের রাস্তা আমাকে একটি নিয়ম শিখিয়েছিল। আর সেই নিয়মটি হলো- লড়াই যদি অনিবার্য হয়, তবে প্রথম ঘুষিটি আপনাকেই ছুড়তে হবে।’
মাশার মতে, ‘তিনি দুর্বোধ্য, প্রচণ্ড উচ্চাভিলাষী, খুবই বেশি আধিপত্যলিপ্সু।’
তিনি বলেন, পুতিনের অভিভাবকেরা সন্তানের উচ্চাভিলাষকে প্ররোচিত করেছেন। কিশোর বয়সে তার একটি হাতঘড়ি ছিল, যা তার বাবারও ছিল না। পুতিনের বাবা-মা একটি গাড়ি জিতে নেয়ার পর সেটি সন্তানকে দিয়ে দেন বলে জানা গেছে।
ছেলেকে রাজা’র মতো দেখার মাধ্যমে পুতিনের মা-বাবা সন্তানের মনে রাজত্ব করার অনুভূতির জন্ম দেন। উদাহরণ দিয়ে মাশা বলেন, ‘এমন অনেক প্রমাণ রয়েছে যে, পুতিন মনে করেন জনগণ তাকেই (নেতা হিসেবে) বেছে নিয়েছে।
এ ধরনের প্রমাণের ক্ষেত্রে তার সুবিশাল ‘প্রাসাদ’ এবং ঘোড়ার পিঠে বুক-খোলা ছবি বিবেচনা করা যেতে পারে। অতি সম্প্রতি ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল মাখোঁকে একটি লম্বা টেবিলের অপর প্রান্তে হাস্যকরভাবে বসিয়ে পুতিন যেন তার নিজস্ব শ্রেষ্ঠত্ববোধেরই প্রকাশ ঘটিয়েছেন।
ক্রেমলিনের ওয়েবসাইটের তথ্য অনুসারে, পুতিন স্কুল শেষ করার আগেই গোয়েন্দা সংস্থায় কাজের বাসনা পোষণ করতেন এবং ১৬ বছর বয়সে তিনি স্বেচ্ছাসেবক হয়েছিলেন। তিনি লেনিনগ্রাদ স্টেট ইউনিভার্সিটি থেকে আইনের ডিগ্রি এবং অর্থনীতিতে ডক্টরেট করেন এবং ১০০ বা তার বেশিসংখ্যক ছাত্রদের মাঝ থেকে তাকে বেছে নেয় কেজিবি।
কলেজে পুতিনের সহপাঠী এবং কেজিবিতে তার সহকর্মী অফিসার পাভেল কোশেলেভের তথ্যগুলো বেশ গুরুত্বপূর্ণ। পুতিন সম্পর্কে কোশেলেভ বলছেন, ‘আমার মতে তার সবচেয়ে অসামান্য বৈশিষ্ট্য হলো, লড়াইয়ের মনোভাব এবং লক্ষ্য অর্জনে দৃঢ়প্রতিজ্ঞা।’
১৯৮০-র দশকের শেষ দিকে কাউন্টার গুপ্তচরবৃত্তির জন্য পুতিনকে পূর্ব জার্মানির ড্রেসডেনে পাঠানো হয়।
সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর তিনি কেজিবি-পরবর্তী এফএসবির প্রধান হন। এরপর প্রেসিডেন্ট বরিস ইয়েলৎসিন ১৯৯৯ সালে পদত্যাগ করলে পুতিন তার উত্তরসূরি হন।
পুতিন বলেছেন, কেজিবি ক্যারিয়ার তাকে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালনের জন্য প্রস্তুত করেছিল। কঠোর সেই জীবনের শৃঙ্খলা এখনও পরিষ্কার ধরা পড়ে; কারণ প্রতিদিন তিনি ১৬ থেকে ১৭ ঘণ্টা কাজে ডুবে থাকেন।
পুতিন ১৯৮০-র দশকের মাঝামাঝি সময়ে সাবেক এয়ার হোস্টেস লিউডমিলা পুতিনাকে বিয়ে করেন। এই দম্পতির দুই কন্যা রয়েছে।
পুতিনের বিপুল কর্মনিষ্ঠা কিন্তু নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে তার পারিবারিক জীবনে। ২০১৬ সালে পুতিন ও লিউডমিলার বিয়েবিচ্ছেদ হয়। কথিত আছে- সংসার ভাঙার কারণ জানিয়ে লিউডমিলা বলেছিলেন, ‘আমরা একে অপরকে খুব কমই দেখতে পাই। ভ্লাদিমির তার কাজ নিয়েই সারাক্ষণ ডুবে থাকে। আর এটাই আমাদের দাম্পত্য জীবনকে শেষ সীমায় নিয়ে এসেছে।