রবিবার, ১০ অক্টোবর ২০২১
প্রথম পাতা » » ভাসানচরকে জাতিসংঘের স্বীকৃতি
ভাসানচরকে জাতিসংঘের স্বীকৃতি
সব অনিশ্চয়তা পেছনে ফেলে নোয়াখালীর ভাসানচরকে মেনে নিয়েছে জাতিসংঘ। ভাসানচরে রোহিঙ্গাদের মানবিক সেবা দিতে গতকাল শনিবার জাতিসংঘ বাংলাদেশের সঙ্গে একটি সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) সই করেছে। সরকারের পক্ষে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. মোহসীন ও জাতিসংঘের পক্ষে বাংলাদেশে জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থা ইউএনএইচসিআরের প্রতিনিধি ইয়োহানেস ফন দের ক্লাউ এমওইউতে সই করেন।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ সচিব মো. মোহসীন গতকাল সন্ধ্যায় বলেন, এই এমওইউ সই করার মধ্য দিয়ে ভাসানচর নিয়ে বাংলাদেশের অবস্থানকে জাতিসংঘ মেনে নিল। এটি এ দেশে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের মানবিক সহায়তা ও সুরক্ষা দিতে বাংলাদেশের অব্যাহত প্রচেষ্টার স্বীকৃতি। এটি বাংলাদেশের বিজয়। অনেক প্রচেষ্টা, কূটনৈতিক তৎপরতার মধ্য দিয়ে এই বিজয় এসেছে। জাতিসংঘের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে ঢাকায় ইউএনএইচসিআরের প্রতিনিধি এই সমঝোতা স্মারক সই করেছেন।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন বলেছেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার বিপুল অর্থ খরচ করে রোহিঙ্গাদের জন্য ভাসানচরে নিরাপদ আশ্রয়ের ব্যবস্থা করেছে। এর উদ্দেশ্য কক্সবাজারে বিশাল রোহিঙ্গার চাপ কিছুটা কমানো এবং ভূমিধস, প্রাকৃতিক দুর্যোগের মতো ঝুঁকি থেকে রোহিঙ্গাদের রক্ষা করা। ভাসানচরে জাতিসংঘের সম্পৃক্ততা বাংলাদেশের প্রচেষ্টার এক ধরনের স্বীকৃতি।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী ডা. মো. এনামুর রহমান সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করাকে জাতিসংঘের সঠিক সিদ্ধান্ত হিসেবে অভিহিত করেন। সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরের ফলে মানবিক সহায়তা সংস্থাগুলোর ভাসানচরে কাজ করা আরো সহজ হবে বলে তিনি জানান।
উল্লেখ্য, সরকার কক্সবাজারের ওপর থেকে চাপ কমাতে এক লাখ রোহিঙ্গাকে ভাসানচরে সরিয়ে নেওয়ার লক্ষ্য ঠিক করেছে। এ পর্যন্ত ছয় দফায় ১৮ হাজার ৫২১ জন রোহিঙ্গাকে ভাসানচরে নেওয়া হয়েছে। এদের মধ্যে শিশু আট হাজার ৭৯০ জন। নারীর সংখ্যা পাঁচ হাজার ৩১৯ ও পুরুষের সংখ্যা চার হাজার ৪০৯ জন। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী সমঝোতা স্মারক অনুষ্ঠানে বলেন, কক্সবাজার থেকে প্রায় ৮০ হাজার রোহিঙ্গাকে আগামী তিন মাসের মধ্যে ভাসানচরে স্থানান্তর করা হবে।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. মোহসীন বলেন, সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হওয়ার পর থেকেই জাতিসংঘ ভাসানচরের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। হয়তো তাদের কার্যক্রম সেখানে স্থানান্তর করতে কিছুটা সময় লাগতে পারে। তবে খুব শিগগির তারা কাজ শুরু করবে।
উল্লেখ্য, কক্সবাজার থেকে ভাসানচরে রোহিঙ্গা স্থানান্তর নিয়ে জাতিসংঘ শুরু থেকেই বিরোধিতা করেছিল। তবে সরকার ভাসানচরে রোহিঙ্গা স্থানান্তর শুরু করার পর জাতিসংঘ সেখানে কারিগরি দল পাঠায়। এ ছাড়া ইসলামী সহযোগিতা সংস্থার (ওআইসি) প্রতিনিধিদলসহ ইউএনএইচসিআর ও বিভিন্ন কূটনৈতিক মিশনের প্রতিনিধিরা ভাসানচর পরিদর্শন করে ইতিবাচক মনোভাব দেখান।
জাতিসংঘসহ আইএনজিওগুলোকে ভাসানচরে রোহিঙ্গাদের মানবিক সহায়তা কার্যক্রমে যুক্ত করতে সরকার এক বছর ধরে জোরালো প্রচেষ্টা চালিয়ে আসছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত মাসে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে ভাষণ দেওয়ার সময় ভাসানচরের প্রসঙ্গ তুলেছেন।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় জানায়, সমঝোতা স্মারক অনুযায়ী জাতিসংঘের সংস্থাগুলো কক্সবাজারের মতো ভাসানচরেও মানবিক সহায়তা দেবে। বেসামরিক প্রশাসনের তত্ত্বাবধানে সেখানে মানবিক সহায়তা কার্যক্রম পরিচালিত হবে। ভাসানচরে রোহিঙ্গাদের খাদ্য ও পুষ্টি, সুপেয় পানি, পয়োনিষ্কাশন, চিকিৎসা, মিয়ানমারের পাঠক্রম ও ভাষায় অনানুষ্ঠানিক শিক্ষা এবং জীবিকার ব্যবস্থা করা হবে। বাংলাদেশ সরকার ভাসানচরে বসবাসরত রোহিঙ্গা এবং কর্মরত জাতিসংঘ ও এর সহযোগী সংস্থা, দেশীয় ও আন্তর্জাতিক এনজিওকর্মীদের নিরাপত্তার বিষয় দেখাশোনা করবে। এ ছাড়া ভাসানচরে রোহিঙ্গাদের বসবাসের কারণে পাশের এলাকা ও জনগণের ওপর যে প্রভাব পড়বে, তা নিরসনে জাতিসংঘের সংস্থাগুলো প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবে।
সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরের আগে ভাসানচরে রোহিঙ্গাদের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, জীবিকার কর্মসূচি, যাতায়াতসহ বিভিন্ন বিষয়ে জাতিসংঘের কাজের ধরন নিয়ে বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে বিশদ আলোচনা হয়েছে। মিয়ানমারে রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গাদের আদি নিবাসের সঙ্গে মিল রেখে ভাসানচরে জীবিকার ব্যবস্থা করা হবে। এ ছাড়া চিকিৎসাসহ জরুরি কারণে রোহিঙ্গাদের সাময়িকভাবে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য ভাসানচরের বাইরে যাওয়ার বিষয়েও আলোচনা হয়েছে।
এদিকে ঢাকায় ইউএনএইচসিআর কার্যালয় জানায়, সমঝোতা স্মারকের মাধ্যমে ভাসানচরে রোহিঙ্গাদের জন্য মানবিক কার্যক্রমের সুরক্ষা ও নীতিমালার একটি সর্বজনীন কাঠামো প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এর মাধ্যমে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর নিরাপদ ও টেকসই প্রত্যাবাসন না হওয়া পর্যন্ত বাংলাদেশের সরকারের ও জনগণের উদারতা ও সহায়তা এবং জাতিসংঘের সহায়তা চালু রাখার প্রত্যয় প্রতিফলিত হয়েছে।
ইউএনএইচসিআর কার্যালয়ের বিজ্ঞপ্তিতে রোহিঙ্গাদের ‘শরণার্থী’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। অন্যদিকে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় রোহিঙ্গাদের ‘বলপূর্বক বাস্তুচ্যুত মিয়ানমারের নাগরিক’ হিসেবে অভিহিত করেছে।
ইউএনএইচসিআর কার্যালয় বলেছে, ভাসানচরবিষয়ক এই ঐকমত্যের মাধ্যমে দ্বীপটিতে অবস্থানরত রোহিঙ্গাদের জন্য সেবা ও কার্যক্রমে সরকার ও জাতিসংঘের ঘনিষ্ঠ সহযোগিতা সম্ভব হবে। এগুলোর মধ্যে আছে সুরক্ষা, শিক্ষা, দক্ষতা প্রশিক্ষণ, জীবিকা ও স্বাস্থ্যসেবা। এর ফলে রোহিঙ্গারা দ্বীপে মানসম্মত জীবন যাপন করতে পারবে এবং ভবিষ্যতে মিয়ানমারে টেকসই প্রত্যাবাসনের জন্য নিজেদের প্রস্তুত করতে পারবে।
তহবিলে ঘাটতি : ইউএনএইচসিআর কার্যালয়ের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, ‘কক্সবাজারে রোহিঙ্গাদের জন্য চলমান মানবিক কার্যক্রমের এ বছরের যৌথ সাড়াদান পরিকল্পনার এখন পর্যন্ত অর্ধেকেরও কম অর্থায়ন হয়েছে। চলমান সহায়তা বাড়ানোর জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি জাতিসংঘ আহ্বান করছে।’
এ বিষয়ে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কক্সবাজারে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের মানবিক সহায়তা কার্যক্রমের জন্য প্রত্যাশিত ৯৪ কোটি ৩০ লাখ মার্কিন ডলারের (প্রায় আট হাজার ৬৪ কোটি ৩৮ লাখ টাকা) ৫২ শতাংশ এখনো মেলেনি। রোহিঙ্গা সংকটে সাড়াদান নিয়ে কাজ করা সংস্থাগুলোর সমন্বয়কারী ইন্টার সেক্টর কো-অর্ডিনেশন গ্রুপের (আইএসসিজি) হিসাব অনুযায়ী, গত ৯ মাসে ৪৪ কোটি ৯০ লাখ মার্কিন ডলার (প্রায় তিন হাজার ৮৩৯ কোটি ৭৭ লাখ টাকা) সহায়তা পাওয়া গেছে। এটি প্রত্যাশিত তহবিলের ৪৮ শতাংশ।
এর আগের চার বছরেও রোহিঙ্গাদের সহায়তা দেওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় তহবিলের পুরো অর্থ পাওয়া যায়নি।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, রোহিঙ্গাদের মানবিক সহায়তা দিতে যৌথ সাড়াদান পরিকল্পনার আওতায় আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে যে তহবিল চাওয়া হয়েছিল তা মূলত কক্সবাজারের কথা চিন্তা করে। ভাসানচরের মানবিক সহায়তা কার্যক্রমের বিষয়টি সেখানে ছিল না। এ কারণে জাতিসংঘ সরকারের সঙ্গে সমঝোতা স্মারক সই করলেও সেখানে তাদের কার্যক্রম পরিচালনার জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ও দাতা সংস্থাগুলোর সহযোগিতা প্রয়োজন হবে। ভাসানচরে কার্যক্রম পরিচালনার জন্য জাতিসংঘের সঙ্গে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরের বিষয়টি উল্লেখ করে এখন জাতিসংঘ ও বাংলাদেশ সরকারকে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে তহবিল চাইতে হবে।
ঢাকায় ইউএনএইচসিআর কার্যালয়ের কাছে প্রশ্ন ছিল, ভাসানচরে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের জন্য আলাদা যৌথ সাড়াদান পরিকল্পনা প্রয়োজন হবে কি না। ইউএনএইচসিআর কি বিদ্যমান তহবিল থেকে ভাসানচরে ব্যয় করবে? ভাসানচরে অর্থায়নের ব্যাপারে ইউএনএইচসিআর কি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতিশ্রুতি পেয়েছে?
জবাবে ইউএনএইচসিআরের কমিউনিকেশনস অফিসার রেজিনা দে লা পোর্টিয়া বলেন, ‘ভাসানচরে জাতিসংঘের সম্পৃক্ততার কারণে যৌথ সাড়াদান পরিকল্পনায় আরো তহবিলের প্রয়োজন হবে। পরিচালনাসংক্রান্ত পরিকল্পনার অংশ হিসেবে বর্তমানে এ নিয়ে কাজ চলছে। আশা করা হচ্ছে এসব চাহিদা পূরণে দাতারা উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখবেন।’
তবে তহবিল নিয়ে অনিশ্চয়তায় পড়ার ভাবনা নাকচ করেছেন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ সচিব মো. মোহসীন। তিনি বলেন, বাংলাদেশ রোহিঙ্গাদের মানবিক সহায়তাকারী দেশগুলোর সঙ্গে কথা বলেছে। তাদের রাষ্ট্রদূত ও প্রতিনিধিরা ভাসানচর ঘুরে সরেজমিনে দেখেছেন। তাঁরা এ ক্ষেত্রে সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছেন।
► সমঝোতা স্মারক সই
► তিন মাসের মধ্যে আরো ৮০ হাজার রোহিঙ্গাকে ভাসানচরে স্থানান্তরের পরিকল্পনা