জুলফিকার ভুট্রোর উৎথান ও পতন
আলোচিত ডেস্ক : তিনি পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর হাতে শেষ হয়েছেন। তার পরও বলতে হয় দম্ভে অন্ধ না হলে হয়তো সম্ভবত রাজনীতিবিদ হিসেবে ভুট্টো ভালো করতেন।
১৯৭৯ সালের ৪ এপ্রিল রাতে রাওয়ালপিন্ডি জেলে জুলফিকার আলী ভুট্টোকে ফাঁসিতে ঝোলানো হয়। কয়েক মিনিটের মধ্যেই তিনি মৃত। ভোরের আলো ফোটার আগেই তার মরদেহ লারকানার কাছে গারহি খুদা বকশ গ্রামে নিয়ে দ্রুততার সঙ্গে দাফন করা হয়। পাকিস্তানের মানুষ ঘুম ভেঙে উঠে ভুট্টোর মৃত্যুর খবর জানার আগেই জিয়াউল হকের সরকার তাকে দাফন করে দেয়। এভাবে তিনি লাগামছাড়া উচ্চাভিলাষ ও সীমাহীন ঔদ্ধত্যের ছায়ায় ম্লান হয়ে শেষমেশ এমন পরিণতি ভোগ করেন।
জুলফিকার আলী ভুট্টো ক্ষমতাচ্যুত হন ১৯৭৭ সালের ৫ জুলাই। যারা তার উত্থান ও পতন দেখেছেন তারা জানেন জীবদ্দশায় তিনি ছিলেন একজন জটিল মানুষ। ফাঁসির অনেক দশক পরেও তিনি তেমনই আছেন। তার অনেক ভক্ত আছেন, বিশেষত পাকিস্তানে, তারা সবসময়ই মনে করেন যে ভুট্টো গণতন্ত্র রক্ষার লড়াইয়ে একজন শহীদ। আবার অনেকে মনে করেন গণতন্ত্রের স্লোগান দিয়ে ক্ষমতায় গিয়ে তিনি সিভিলিয়ান একনায়কতন্ত্রের মাধ্যমে গণতন্ত্রকে সমাধিস্থ করার জন্য যা যা করা সম্ভব তার সবটাই করেছেন।
ভুট্টোর জীবন ও ক্যারিয়ার নিয়ে এতদিন বহু বই প্রকাশিত হয়েছে, সামনের দিনে আরো হবে তা বলাই যায়। বিশেষত ২০০৭ সালের ডিসেম্বরে তার কন্যা বেনজির ভুট্টোর হত্যাকাণ্ডের পর ভুট্টো কিংবদন্তি নতুন ও আরো বিস্তৃত মাত্রা নিয়েছে। মনে রাখা প্রয়োজন যে আমরা যে মানুষটিকে নিয়ে কথা বলছি তিনি ১৯৭০-এর দশকের শুরুর দিকে ইতালীয় সাংবাদিক ওরিয়ানা ফালাচির সঙ্গে কথা বলার সময় রীতিমতো উন্মাদের মতো আচরণ করেছিলেন। ক্ষমতালোভী মানুষ হিসেবেই তিনি ফালাচির সামনে হাজির ছিলেন, কিন্তু তার ‘পাগলামি’র যে ঝলক দেখা গিয়েছিল তা জাঁদরেল সাংবাদিককেও বিস্মিত করেছিল। ইন্দিরা গান্ধী, শেখ মুজিবুর রহমান এবং প্রায় সবার ক্ষেত্রেই ভুট্টোর অভব্য মন্তব্য যেকোনো ভদ্র মানুষের কাছে দুর্বিষহ মনে হবে। এমনকি ভুট্টো নিজেও পরবর্তী সময়ে এটা বুঝতে পেরেছিলেন। তখন তিনি ইতালিতে অবস্থানরত পাকিস্তানের কূটনীতিককে ফালাচির কাছে পাঠিয়েছিলেন সাক্ষাত্কারটি তুলে নেয়ার জন্য অথবা এটা ‘ঘোষণা’ দিতে যে ফালাচি অনেক কথা ভুট্টোর নামে বানিয়ে লিখেছেন!
ফালাচির সাক্ষাত্কারে যেভাবে পাওয়া যায় ভুট্টো মূলত তাই। স্ট্যানলি ওলপার্টের জুলফি ভুট্টো অব পাকিস্তান বইতেও ভুট্টোর এ পরিচয়ই উঠে এসেছে। আমেরিকান একাডেমিক ওলপার্ট তার গান্ধী’জ প্যাশন ও জিন্নাহ অব পাকিস্তান-এর মতো গুরুত্বপূর্ণ কাজের জন্য প্রশংসিত। ভুট্টোকে নিয়ে লিখতে গিয়ে ওলপার্ট সব ধরনের সুবিধা পেয়েছিলেন, যেমন ভুট্টো পরিবার তাকে ভুট্টোর লাইব্রেরি ও কাগজপত্র দেখার সুযোগ দিয়েছিলেন। ভুট্টোকে নিয়ে ওলপার্টের বিশ্লেষণ সহানুভূতিসম্পন্ন, তার মতে ভুট্টো রাজনীতিবিদ হিসেবে যা করেছেন তার চেয়ে আরো ভালো করতে পারতেন। ওলপার্ট জুলফিকার আলী ভুট্টোর উত্থানের সন্ধান করেছেন বিদেশে উচ্চশিক্ষা নিয়ে পাকিস্তানে ফেরার পর এবং আরো অনেক প্রভাবকের যেগুলো তার উত্থানে সহায়তা করেছিল।
১৯৫০-এর দশকের শুরুর দিকে ভুট্টো ছিলেন আইনের তরুণ অধ্যাপক। ১৯৫৮ তে জেনারেল ইস্কান্দার মির্জার অভিভাবকত্বে কেবিনেট মন্ত্রী হিসেবে খুশি ছিলেন। মির্জা গণতন্ত্রের প্রতি প্রসন্ন ছিলেন না। মির্জাকে সরিয়ে জেনারেল আইয়ুব খান ক্ষমতা নেয়ার পর ভুট্টো দ্রুতই তার অবস্থান বদল করে নতুন শাসকের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেন। এ ঘটনার একটা পরিষ্কার চিত্র পাওয়া যায় ইস্কান্দারের পুত্র হুমায়ূন মির্জার লেখা তার পিতার জীবনীগ্রন্থে। হুমায়ূন মির্জা লিখেছেন, ভুট্টো প্রথম সাক্ষাতেই প্রেসিডেন্ট জেনারেল মির্জার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন। ইস্কান্দার ভুট্টোকে নিয়ে এতটাই সন্তুষ্ট হয়েছিলেন যে পাকিস্তানের সেন্ট্রাল কেবিনেটে এ তরুণ আইনজীবীর জন্য একটা জায়গা তৈরি করে দেন। বদলে ভুট্টো মির্জাকে তার কৃতজ্ঞতা প্রকাশে আগ্রহী ছিলেন। বিগলিত বয়ানে ভুট্টো প্রেসিডেন্ট মির্জাকে বলেছিলেন যে ইতিহাস ইস্কান্দার মির্জাকে পাকিস্তানের শ্রেষ্ঠ সন্তান হিসেবে স্মরণ করবে, এমনকি দেশটির স্থপতি মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ থেকেও মহান হিসেবে। ১৯৫৮ সালের অক্টোবরের শেষ দিকে মির্জা ও তার স্ত্রী নাহিদ ব্রিটেনে নির্বাসনে যান। ভুট্টো আইয়ুব খানের সদয় দৃষ্টি নিশ্চিত করেন। পরবর্তী আট বছর তাকে আর ফিরে তাকাতে হয়নি। তিনি ছিলেন বাণিজ্য, শিল্প ও প্রাকৃতিক সম্পদ বিষয়ক মন্ত্রী।
১৯৬০ সালে তিনি এনার্জি সেক্টরে সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে একটি চুক্তি করেন, যা পাকিস্তান ও বাইরের সবাইকে চমকে দিয়েছিল। ১৯৬৩ সালে মোহাম্মদ আলী বোগরার মৃত্যুর পর তিনি আইয়ুবের মন্ত্রিসভায় পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব পান। সঙ্গে ছিল কনভেনশন মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব, এটা ছিল আইয়ুবের একনায়কতান্ত্রিক শাসনের সমর্থক রাজনীতিবিদদের মোর্চা। এটা ছিল ভুট্টোর সেরা সময়। তিনি প্রস্তাব করেন প্রেসিডেন্ট হিসেবে আইয়ুব খানের আমৃত্যু ক্ষমতায় থাকা উচিত। এভাবে এ সময় তিনি অন্যদের তামাশার খোরাকও হয়েছিলেন।
ওলপার্টের বই এটা পরিষ্কার করে দেয় যে এর পরও এমন একটা সময় আসে যখন উচ্চাভিলাষী ও ঔদ্ধত্য ভুট্টো নিজে আইয়ুবকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করতে শুরু করেন। ১৯৬৬ সালের জানুয়ারির এক রাতে তাসখন্দে পররাষ্ট্র সচিব আজিজ আহমেদ খবর দেন ‘দ্য বাস্টার্ড ইজ ডেড’, শুনে ভুট্টো জিজ্ঞেস করেন, ‘কোনটা?’ এ ঘটনা তার উগ্র ঔদ্ধত্যপূর্ণ, ঘৃণামিশ্র আচরণের অনেক নিদর্শনের একটি মাত্র। এ দৃষ্টিতে তিনি যেমন তার গুরুকে দেখেছেন তেমনি দেখেছেন লাল বাহাদুর শাস্ত্রীকেও। অন্যদিকে ওলপার্ট এটাও উল্লেখ করেছেন কীভাবে ১৯৭১-পরবর্তী সময়ে ভুট্টো পাকিস্তানের নাগরিকদের আস্থায় ফিরিয়ে এনেছিলেন। তখন বাংলাদেশের অভ্যুদয় এবং ৯৩ হাজার পাকিস্তানি সৈন্যের আত্মসমর্পণ সে দেশের মানুষকে বড় ধাক্কা দিয়েছিল। তিনি পরিস্থিতির গুরুত্ব অনুধাবন করেছিলেন, যে বাস্তবতা তার সামনে এসে হাজির হয়েছিল সেটাও বুঝেছিলেন।
পাকিস্তানের ওপর যে বিপর্যয় নেমে এসেছিল তার জন্য যারা দায়ী, তার মধ্যে যে ভুট্টো অন্যতম সেটা বোঝার জন্য কাউকেই খুব বেগ পেতে হতো না, কিন্তু তিনি নিজে তা মানতে নারাজ ছিলেন। তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ অন্যদের ওপর দোষ দিয়েছেন দেশ ভেঙে যাওয়ার জন্য, কিন্তু তিনি বাঙালিদের ওপর চালানো গণহত্যায় নিজের অপরাধ স্বীকার করেননি। অবশ্য শেষমেশ তিনি নিজে বিনীত হয়ে পরাজয় মেনেছিলেন। পাকিস্তানের কারাগারে বন্দি বাঙালির নেতাকে মুক্তি দিয়েছিলেন এবং তাকে বিদায় জানাতে চাকলালা বিমানবন্দরেও এসেছিলেন। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে বিমান রাতের আকাশে উড়াল দিলে ভুট্টো আনমনে বিড়বিড় করে উঠেছিলেন, ‘দ্য নাইটিঙ্গেল হ্যাজ ফ্লোন।’
আরেকজন ছিলেন রাফি রাজা, তিনি অবশ্যই কোনো নাইটিঙ্গেলের কথা বলেননি। রাজনৈতিক মিত্র হিসেবে রাজা প্রত্যক্ষ করেছিলেন ভুট্টোর উত্থান-পতনের ঘটনাবহুল ১০টি বছর (জুলফিকার আলী ভুট্টো অ্যান্ড পাকিস্তান: ১৯৬৭-১৯৭৭)। স্বাভাবিকভাবেই বইটি শুরু হয়েছে ১৯৬৭ সাল থেকে, যখন ভুট্টোর সঙ্গে সম্পর্ক ছিল রাজা, মুবাশির হাসান, জেএ রহিম, মেরাজ মোহাম্মদ খান, আবদুল হাফিজ পীরজাদা ও আরো অনেকের; যারা পাকিস্তান পিপলস পার্টিকে গড়ে তুলেছিলেন। সেটা ছিল নভেম্বর মাস, এক বছরের বেশি সময় ধরে ভুট্টো মন্ত্রিত্ব হারিয়েছেন। আইয়ুব খানের বিরাগভাজন হয়ে তাকে পদ ছাড়তে হয়েছিল। ১৯৬৬ সালের জুলাই থেকে ১৯৬৭ সালের নভেম্বর সময়কালে ত্রস্ত ভুট্টো তার ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত ছিলেন। তাসখন্দ চুক্তির কারণে তিনি ফিল্ড মার্শালের সমালোচনা করেছিলেন—এ চুক্তির একটি ধারাকে তিনি পাকিস্তানের প্রতি আইয়ুবের বিশ্বাসঘাতকতা হিসেবে গণ্য করেন—অবশ্য ভুট্টো তার পদচ্যুতির জন্য প্রস্তুত ছিলেন না। কিন্তু তাকে পদচ্যুত করা হয়। ১৯৬৬ সালের জুলাইয়ের পর তিনি একজন শঙ্কিত মানুষ। আইয়ুবের কর্তৃত্ব তখনো অবিসংবাদিত এবং ক্লান্তিহীনভাবে তিনি রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে কারাগারে পাঠিয়েছিলেন। ভুট্টোকেও তিনি কারাগারে পাঠাতে পারতেন।
প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান শেষমেশ ভুট্টোকে কারাগারে পাঠিয়েছিলেন, তবে সেটা ১৯৬৮ সালের নভেম্বরে। ততদিনে পাকিস্তান পিপলস পার্টি প্রতিষ্ঠার এক বছর পেরিয়ে গেছে। কিন্তু তিন মাসের মধ্যেই ভুট্টোকে মুক্তি দিতে হয়েছিল, কারণ পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানে ক্রমবর্ধমান অসন্তোষে সরকার টালমাটাল হয়ে উঠেছিল। পাকিস্তান পিপলস পার্টি (পিপিপি) প্রতিষ্ঠার পরিপ্রেক্ষিতে ইতিহাসের বিবেচনায় ১৯৬৭ সাল পাকিস্তানের জন্য একটি সন্ধিক্ষণ ছিল। পশ্চিম পাকিস্তানের সামন্তীয় সংস্কৃতিতে ইতিহাসে প্রথমবার আনুষ্ঠানিকভাবে পপুলিস্ট স্লোগান নিয়ে একটি রাজনৈতিক দলের উত্থান ঘটল। ভুট্টো পাকিস্তানকে ইসলাম ধর্ম, গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রের এক কৌতূহলোদ্দীপক মিশ্রণের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। অবশ্য কীভাবে এ লক্ষ্য অর্জন করবেন সে ব্যাপারে অতি অবশ্যই কোনো ব্যাখ্যা তিনি দেননি। এখানে দেখার বিষয় ছিল জনগণ কীভাবে তার এ মন্ত্রকে গ্রহণ করেন এবং তারা তা ভালোভাবেই গ্রহণ করেছিলেন। ভুট্টো যেখানে যেতেন মানুষ তাকে ঘিরে ধরত, জনগণ তাকে দেখার জন্য বা কথা শোনার জন্য রেলস্টেশন কিংবা সড়ক আটকে দিত। পশ্চিম পাকিস্তানের ইতিহাসে আর কোনো রাজনীতিবিদ এত দ্রুত নিজেকে জনপ্রিয় নেতায় পরিণত করতে পারেননি। এসব ঠিক সে সময়ে ঘটছিল যখন দূরের পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ তাদের কণ্ঠস্বর খুঁজে পেয়েছিলেন তাদেরই একজনের মাঝে, তিনি আরো দৃঢ় ও স্বতন্ত্র—শেখ মুজিবুর রহমান।
অবশ্যই রাফি রাজা ছিলেন তোষামুদে প্রকৃতির। তার পরও তিনি বিভিন্ন সময় ভুট্টোর সঙ্গে তার মতপার্থক্যকে প্রকাশ করেছেন। এর পরও তিনি ভুট্টোর ক্রোধের শিকার হননি, যেমনটা অন্য অনেকে হয়েছিলেন (পরাজিত ইয়াহিয়া খানের কাছ থেকে ১৯৭১ সালের ডিসেম্বরে ক্ষমতা নেয়ার অব্যবহিত পরেই পাকিস্তানের প্রথম নির্বাচিত শাসক ভুট্টো তার ক্ষমতার দম্ভ দেখাতে শুরু করেছিলেন)। ভুট্টোর প্রাজ্ঞতা নিয়ে প্রশ্ন তোলার হিম্মত দেখানোর অপরাধে তার গুণ্ডারা জে এ রহিম ও মেরাজ মোহাম্মদ খানকে বেশ পিটিয়েছিল। সেটা ছিল সে সময় যখন ভুট্টো প্রথমে প্রেসিডেন্ট এবং পরবর্তী সময়ে প্রধানমন্ত্রী। এর আগে এটা ছিল কয়েকজন আদর্শবাদী মানুষের একটি দল, যারা পিপিপির মাধ্যমে পাকিস্তানের রাজনীতিতে বদল আনার সংকল্প করেছিলেন। এ স্বপ্ন বাস্তবায়িত হওয়ার লক্ষণ দেখা যায় ১৯৭০-এর শেষে নির্বাচনে পশ্চিম পাকিস্তানে দলটির জয়ে। কিন্তু এখানে একটা সমস্যা ছিল। ভুট্টো ও তার দল দ্রুতই বুঝতে পারেন তাদের গৌরব ক্ষণকালের, কারণ শেখ মুজিবুর রহমানের আওয়ামী লীগ সবাইকে পেছনে ফেলে পুরো পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে।
গল্পের বাকি অংশ এখন বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের ইতিহাসের অংশ। পিপিপির অন্য সবার মতো রাফি রাজাও নির্বাচনের ফল মেনে নিতে তাদের দলের অস্বীকৃতির বিষয়টি সতর্কভাবে এড়িয়ে গেছেন। কিন্তু এ কারণে পরবর্তী সময়ে যে জটিলতাগুলো সৃষ্টি হয়েছিল তা তিনি স্বীকার করেছেন। তিনি আরো জানিয়েছেন, ১৯৭১ সালের ২৩ মার্চ (সেদিন বাঙালিরা পাকিস্তান ডে পালনে অস্বীকৃতি জানিয়ে সারা ঢাকার বাড়িঘরে বাংলাদেশের পতাকা উড়িয়েছিল) ঢাকায় পিপিপির এক সভায় উপস্থিত বেশির ভাগ সদস্য যখন আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে সামরিক পদক্ষেপ নিতে ইয়াহিয়া সরকারকে সমর্থন দিচ্ছিল, তখন তিনি সেখানে অল্প কয়েকজন মধ্যপন্থীর একজন ছিলেন।
রাজার মনোযোগ ছিল ১৯৭১-এর শেষভাগ থেকে ১৯৭৭ সালের মধ্যকাল পর্যন্ত ভুট্টোর সরকারের ওপর। বিভিন্ন সীমাবদ্ধতার মধ্যেও এ সরকার যেসব ক্ষেত্রে সফল হয়েছিল, সেগুলো তিনি ঠিকঠাক তুলে ধরেছেন। একই সঙ্গে তিনি ভুট্টোর চরিত্রের গভীর ত্রুটিগুলো—যেসব কারণে ভুট্টো ডুবেছিলেন, সেগুলোও হাজির করেছেন। রাজার কথায়, ‘যদি (জনগণের) স্মৃতিশক্তি ভালো না হয়ে থাকে, তাহলে সে সমস্যা জুলফিকার আলী ভুট্টোরও ছিল। ক্ষমতায় বসার কয়েক বছরের মধ্যেই তিনি জনগণের ক্ষমতাকে ভুলে গিয়েছিলেন, যা ছিল তার ক্ষমতার একমাত্র ও প্রকৃত উৎস।’
ইফ আই অ্যাম অ্যাসাসিনেটেড গ্রন্থে যে অংশটি পাঠকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে তা হলো ভারতীয় সাংবাদিক প্রাণ চোপড়ার লেখা ভূমিকাটি। লেখাটি যে জুলফিকার আলী ভুট্টোর, সে বিষয়টি তুলে ধরে প্রাণ চোপড়া লিখেছেন, ‘তিনি ইতিহাসের সঙ্গে কথা বলেছেন নিজের মন ও উন্নয়নশীল দুনিয়ার অন্যতম একটি কৌতূহলোদ্দীপক দেশে তার নিজস্ব অভিজ্ঞতার পাটাতনে দাঁড়িয়ে।’
বলা হয় বিতর্কিত একটি হত্যা মামলায় মৃত্যুদণ্ড পাওয়া ভুট্টো যখন কারাগারে বন্দি, তখন নিজের অন্তিম দিনগুলোয় তিনি ইফ আই অ্যাম অ্যাসাসিনেটেড রচনা করেছিলেন।
এক বিবেচনায় এটি তার এক ধরনের স্বীকারোক্তি, পাকিস্তানের আধুনিক ইতিহাসে তার ভূমিকা, ভাবনার সংকলন। সাবলীল ও ভাবনায় উর্বর—পুরনো ভুট্টোর সেরা রূপ দেখা যায় এ রচনায়। পাকিস্তানের রাজনীতি ও ১৯৭১ সালে দেশটি ভেঙে যাওয়ার ক্ষেত্রে পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর ভূমিকা তিনি বিশ্লেষণ করেছেন (অবশ্য এ বিপর্যয়ে তার নিজের ভূমিকা নিয়ে একটি শব্দও উচ্চারণ করেননি)। তিনি হামুদুর রহমান কমিশনের প্রতিবেদন নিয়ে ভেবেছেন। পাঠকদের সামনে নিজের প্রশাসন সম্পর্কে মূল্যায়ন হাজির করেছেন, একই সঙ্গে লিখেছেন তাদের ওপর থাকা স্থানীয় ও বিদেশী নানা চাপের কথা।
রচনার অনেক দশক পরেও কেউ ইফ আই অ্যাম অ্যাসাসিনেটেড পড়লে ভুট্টো তার দেশের জন্য যে সম্ভাবনার ইঙ্গিত বহন করছিলেন তা উপলব্ধি করতে পারবেন। একই সঙ্গে এটাও বুঝতে পারবেন কেন তিনি এত দ্রুত এবং চরমভাবে পতিত হয়েছিলেন।
ভুট্টোর ট্র্যাজেডি তুলনাহীন; পাকিস্তান সেনাবাহিনী তাকে ক্ষমতার শীর্ষে তুলে দিয়েছিল এবং এ সেনাবাহিনীই আবার তাকে ধ্বংস করে দিয়েছে। যাত্রাপথে তিনি অনেক ওয়াদা করেছিলেন, কিন্তু তারপর নিজের ম্যাকিয়াভেলিয়ান আত্মার মধ্যে ঘুরপাক খেয়েছেন। তার কূটনীতি তাকে সফল করেছে। তার ধূর্ততা লাখ লাখ মানুষের মৃত্যুর কারণ, যেখান থেকে একদিন বাংলাদেশের জন্ম।
সৈয়দ বদরুল আহসান: সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক। ফ্রম রেবেল টু ফাউন্ডিং ফাদার: শেখ মুজিবুর রহমানসহ একাধিক গ্রন্থের প্রণেতা।
ইংরেজি রচনাটি ভাষান্তর করেছেন: শানজিদ অর্ণব