জুলফিকার ভুট্রো ও হুসনার রোম্যান্স
আলোচিত প্রতিবেদন : জুলফিকার আলী ভুট্টোর জীবনের দিকে তাকালে দেখা যায়, তিনি দুই স্ত্রী গ্রহণ করেছিলেন—এ কথা সবার জানা। এদের মধ্যে প্রথমা স্ত্রী শিরিন আমির বেগম তুলনামূলক নীরব থাকতেই পছন্দ করতেন। তিনি অনেকটা লোকচক্ষুর আড়ালেই জীবন কাটিয়ে গেছেন। দ্বিতীয় স্ত্রী নুসরাত ইস্পাহানি মূলত পাকিস্তানের ফার্স্ট লেডি হিসেবে পরিচিত এবং জুলফিকারের ক্ষমতাকালীন তো বটেই, পরবর্তী সময়েও তিনি মানুষের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে ছিলেন। পাকিস্তানের দুবারের প্রধানমন্ত্রী বেনজির ভুট্টো জুলফিকার ও নুসরাত দম্পতিরই সন্তান। কিন্তু এ দুই স্ত্রী ব্যতিরেকেও আরেকজন নারীর সঙ্গে জুলফিকার আলীর সম্পর্ক ছিল এবং প্রেম থেকে তা একসময় পরিণয়েও পৌঁছেছিল। আরো কৌতূহলোদ্দীপক বিষয় হলো জুলফিকারের এ ‘গোপন বিবি’ একজন বাঙালি-পাঠান।
জুলফিকার আলী সম্পর্কে যারাই কিছু বলেছেন বা লিখেছেন, সবাই বলেছেন এ ব্যক্তি একাধারে বহির্মুখী ও অন্তর্মুখী। কোনো কোনোদিন হয়তো তিনি কথা বলতে বলতে রাজনীতি, ইতিহাস, ক্রিকেট, সংগীত, কবিতা সম্পর্কে বলেই চলতেন; আবার এমনকি প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব পালনকালেও কোনো কোনোদিন একা ঘরে বসে হুইস্কির গ্লাস ও বই নিয়ে সম্পূর্ণ দিন কাটিয়ে দিতেন। এহেন জুলফি একজন রমণী মোহন পুরুষ ছিলেন সে কথা বলা বাহুল্য। ১৯৬১ সালে তত্কালীন পূর্ব পাকিস্তানের ঢাকায় খলিল ওমরের বাড়িতে একটি অনুষ্ঠানে জুলফিকারের দৃষ্টি একজন বাঙালি নারীর প্রতি নিবদ্ধ হয়, ঠিক যেমন ৩৭ বছর আগে তার বাবা দেখেছিলেন লাখি বাঈকে। জুলফি যাকে দেখে মজেছিলেন তার নাম হুসনা শেখ। প্রতিষ্ঠিত আইনজীবী আব্দুল আহাদের স্ত্রী হুসনা তখনো বিশের কোটা পার করেননি। দুই কন্যার জননী হুসনার হুসন (সৌন্দর্য) দর্শনের পাশাপাশি ইংরেজি, উর্দু ও বাংলায় পারদর্শী এ নারীকে জুলফি কিছুতেই ভুলতে পারেননি।
বাঙালি-পাঠান রক্তের অধিকারী হুসনা ছিলেন বুদ্ধিমতী ও বাস্তববাদী। তার জন্ম ও বেড়ে ওঠা কলকাতায় ১৯৩০-এর দশকে। মাহলিয়া লোন লেখেন, ‘হুসনা ছিলেন দীর্ঘাঙ্গী, চাপা রঙের অধিকারী। গলার স্বর খানিক রুক্ষ।’ সপ্রভিত এ বাঙালি নারী সেদিনের আলোচনায় জুলফিকারের মনোযোগ আকর্ষণ করেছিলেন কেননা তিনি বলেছিলেন, পশ্চিম পাকিস্তানের সামন্ত শাসনের কারণেই বাংলাদেশ আন্দোলন দৃঢ় হবে। লারকানার ‘জমিদার’ জুলফির নিশ্চয়ই সে কথা পছন্দ হয়নি কিন্তু হুসনার মধ্যকার স্ফুলিঙ্গ তিনি আবিষ্কার করেছিলেন এবং সেখান থেকেই হুসনার প্রতি তিনি আকর্ষিত হয়েছিলেন।
কিন্তু বাস্তববাদিতার কারণেই হয়তো হুসনার কাছে পৌঁছতে জুলফিকে বেগ পেতে হয়েছিল। সন্তান, পরিবারের কথা ভেবে থাকবেন হুসনা, যে কারণে জুলফির কাছে ধরা দেননি। কিন্তু তুখোড় আইনজীবী, তত্কালীন সময়ে আইয়ুব খানের ‘চোখের মণি’ জুলফি কিছুতেই চেষ্টায় ক্ষান্ত হননি। অবশেষে হুসনাকে একসময় পুরনো সম্পর্কের সুতো কেটে দিতে হয়। ১৯৬৫ সালে বাঙালি সংসার এবং পরিচয় ত্যাগ করে হুসনা তার দুই কন্যাকে সঙ্গে নিয়ে করাচি চলে যান।
হুসনা পশ্চিম পাকিস্তানে গেলে জুলফি তাকে তত্কালীন করাচির অভিজাত এলাকা বাথ আইল্যান্ডে বসবাসের বন্দোবস্ত করে দেন। জুলফির নিজের আবাস ৭০, ক্লিফটন থেকে হুসনার নিবাসের দূরত্ব ছিল কেবল ১০ মিনিটের ড্রাইভ এবং মুস্তাফা খার এ সময় জুলফিকারকে সহায়তা করেন। ২০১৬ সালে দ্য ফ্রাইডে টাইমসে প্রকাশিত নিবন্ধে মাহলিয়া লোন লেখেন, ‘জুলফিকারের তত্কালীন ঘনিষ্ঠ সহচর মুস্তাফা খারই একমাত্র এ সম্পর্কের কথা জানতেন। তিনিই গোপনীয়তার সঙ্গে জুলফিকারকে হুসনার ফ্ল্যাটে পৌঁছে দিতেন।’
জুলফিকারের পরবর্তী সময়গুলো বেশ জটিলতায় পূর্ণ। নানা কারণে আইয়ুব খানের সঙ্গে তার সম্পর্কের অবনতি হয়েছিল। একসময় নিজের দলেই তার অবস্থান টলে যায়। হুসনা মূলত একজন ধীরস্থির ও দৃঢ় মানসিকতার নারী ছিলেন। তবু জুলফির সঙ্গে তার সম্পর্কের অবনতি হয়। তাহমিনা দুররানীর বরাত দিয়ে মাহলিয়া লোন লেখেন, ‘এ সময় অবস্থা এমন পর্যায়ে দাঁড়ায় যে কোনো কোনোদিন জুলফির মুখের ওপরই হুসনা দরজা বন্ধ করে দিতেন।’ হুসনা নিজেকে জুলফিকারের হাতের পুতুল করেননি। নিজস্ব যোগাযোগের মাধ্যমে আবুধাবির শেখ ফাতিমার প্রাসাদ সজ্জার কাজে চুক্তিবদ্ধ হন এবং পরবর্তী সময়ে করাচিতে নিজস্ব সম্পত্তি তৈরি করে ফেলেছিলেন।
জুলফির সঙ্গে হুসনার এ প্রণয়ের নেপথ্যে কী কাজ করেছে, এমন প্রশ্ন মনে আসা স্বাভাবিক। মাহলিয়া লোন ও তাহমিনা দুররানির লেখা থেকে মনে হয় জুলফি তার বৈবাহিক জীবনে সুখী হননি। শিরিন আমির বেগম একজন অন্তর্মুখী নারী। সেখানে নুসরাত ইস্পাহানি তুলনামূলক চটপটে হলেও জুলফির সঙ্গে পুরোপুরি মনের মিল হয়নি। হুসনার সঙ্গে জুলফির বোঝাপড়া ছিল চমত্কার। জুলফি কেবল হুসনার সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে মাধুকরী করতে আসেননি, বরং একান্ত সময় যাপনে তারা রীতিমতো নানা বিষয়ে আলোচনা করতেন। এ পারস্পরিক সমঝোতা, মানসিক মিলনের কারণেই হুসনার কাছে জুলফি একটি পূর্ণাঙ্গ সম্পর্কের স্বাদ পেয়েছিলেন। জুগনু মোহসিনের সঙ্গে ১৯৯০ সালে এক সাক্ষাত্কারে খোদ হুসনা বলেছেন, ‘রসায়নটাই অন্য রকম ছিল। আমি আর জুলফি যখন একত্রে সময় যাপন করতাম, পরস্পর ব্যতীত কোনো অপার্থিব বিষয় আমাদের মধ্যে কাজ করত।’
হুসনা একজন দৃঢ়চিত্ত নারী ছিলেন, সে কথা সবাই বলেছেন। জুলফি নিজেও হুসনার মধ্যকার সেই আগুনকেই পছন্দ করেছিলেন। হুসনা তার লক্ষ্যে স্থির থাকতে জানতেন। নিজের উপার্জনে করাচিতে মুর ঘরানার নকশায় যে বাড়ি করেছিলেন, তার নাম রেখেছিলেন ‘মঞ্জিল’। উর্দুতে মঞ্জিল শব্দের অর্থ ‘লক্ষ্য’, অর্থাৎ কেউ যেখানে পৌঁছতে চায়। হুসনা নিজের লক্ষ্যে অটল ছিলেন। বহু উত্থান-পতনের পরও হুসনার সঙ্গে জুলফিকারের সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন হয়নি। ১৯৬৮ সালে আইয়ুববিরোধী আন্দোলনের সময় জুলফি ও পাকিস্তান পিপলস পার্টি আলোচনায় আসে এবং এ সময়কালে হুসনাও জুলফিকে বিয়ের ব্যাপারে সম্মত করতে সক্ষম হন। বিয়ের ব্যাপারে রাজি হতে না হতেই ভুট্টো গ্রেফতার হন। এ পর্যায়ে হুসনাকে শান্ত হয়ে আরো কিছুদিন অপেক্ষা করতে বলা ছাড়া আর কিছুই করার ছিল না। পরবর্তী সময়ে জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার পরও নানা কারণে তাদের বিয়ে সম্ভব হয়ে ওঠেনি। এ সময়ের মধ্যে নানা পর্যায়ে নানা মাত্রায় তাদের মধ্যে বাদানুবাদ চলতে থাকে। এমনকি হুসনার রাগের সামনে জুলফিকার হাউমাউ করে কেঁদেছেন বলেও মাহলিয়া লোন লিখেছেন।
পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট হওয়ার কিছুদিন পরই হুসনাকে জুলফিকার বিয়ে করেন। পাকিস্তান পিপলস পার্টির একজন সদস্য এবং ইসলামী পণ্ডিত কাওসার নিয়াজি এ বিয়ের কাজির দায়িত্ব পালন করেন। বিয়ের কিছুদিনের পরই নুসরাত ইস্পাহানি এ খবর পেয়েছিলেন এবং তিনি আত্মহত্যার চেষ্টা করেন। কিন্তু সময়মতো হাসপাতালে স্থানান্তরের কারণে তিনি বিপদমুক্ত হলে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট মশাই স্ত্রীর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করেন। পরবর্তী সময়ে নুসরাত ইস্পাহানি পাকিস্তানের ‘ফার্স্ট লেডি’ হিসেবে পরিচিত হন। অন্যদিকে হুসনা বারবার দাবি করা সত্ত্বেও জুলফিকার তাকে সবার সম্মুখে আনেননি। হুসনা বরাবরই জুলফিকারের ‘গোপন স্ত্রী’ হিসেবেই ছিলেন।
কিন্তু এখানেই কাহিনী শেষ হয় না। স্বীকৃতি না মিললেও হুসনার হাতে প্রভূত ক্ষমতা জমা হয়েছিল। ক্ষমতার অন্দরমহলে অবস্থান করলে স্বভাবতই এ রকম হয়ে থাকে। জুলফিকার প্রেসিডেন্ট হলে হুসনার বাড়িতে আমলা, ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে ক্ষমতাধর এবং সুযোগসন্ধানী ব্যক্তি এমনকি মন্ত্রীদের যাতায়াত লেগে থাকত। বলা হয়ে থাকে, নিজের ফ্ল্যাটে বসেই হুসনা একটি ঘরোয়া মন্ত্রিসভা (কিচেন কেবিনেট) পরিচালনা করতেন। পাকিস্তান পিপলস পার্টির প্রয়াত রাজনীতিবিদ সালমান তাসির বলেছিলেন, ‘হুসনা শেখ ছিলেন পাকিস্তানের মাদাম দে পম্পাদো (ফ্রান্সের রাজা পঞ্চদশ লুইয়ের মিস্ট্রেস, যিনি রাজকার্য পরিচালনায় ভূমিকা রাখতেন)।’
কিন্তু জুলফিকারের পরিবারের সঙ্গে হুসনার ভালো সম্পর্ক তৈরি হয়নি। বিশেষত বেনজির ভুট্টো হুসনাকে বরাবর অপছন্দ করতেন। হুসনা নিজেই বলেছেন, তার প্রতি বেনজিরের কোনো সহানুভূতি ছিল না। বরং মোর্তজাই (জুলফি ও নুসরাতের পুত্র) তার প্রতি সহানুভূতিশীল ছিলেন। জুলফিকারের সরকারের পতন যখন হয়, হুসনা তখন লন্ডনে। সরকার পতন থেকে শুরু করে জুলফিকে ফাঁসি দেয়ার খবর মোর্তজাই তাকে দিয়েছিলেন।
কেউ কেউ হয়তো বলবে হুসনা ক্ষমতার লোভে পড়েছিলেন। কিন্তু সত্যি বলতে হুসনার সঙ্গে যখন জুলফির সম্পর্ক তৈরি হয়, তখন জুলফিকার কেবলই উদীয়মান একজন ব্যক্তি। আইয়ুবের সঙ্গে পরবর্তী সময়ে তার সম্পর্কের অবনতি এমনকি জুলফির রাজনৈতিক ক্যারিয়ারের পতন হওয়া অসম্ভব ছিল না। সেসব পেরিয়েও হুসনা তার সঙ্গেই ছিলেন। এমনকি জিয়া- উল-হকের সরকার যখন জুলফির প্রহসনের বিচার করছে, তখন হুসনাই ইংল্যান্ডের বিখ্যাত আইনজীবী জন ম্যাথিউসকে নিয়োগ করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু সে আবেদন নাকচ করা হয়। জুলফির পরিবারের রোষানলে থাকা সত্ত্বেও শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত হুসনা জুলফিকে রক্ষার চেষ্টা করেছিলেন।
জুলফির মৃত্যুর পর তিনি আত্মহত্যার চেষ্টা করেন, কিন্তু তার ও জুলফির একমাত্র সন্তান শামীমের কথা ভেবেই শেষ পর্যন্ত নিরস্ত হন।
সূত্র: গুড টাইমস ম্যাগাজিন (গুড টাইমস ম্যাগাজিন পাকিস্তানের লাইফস্টাইল, সংস্কৃতি বিষয়ক প্রথম পাক্ষিক)