নারী দিবস কতটুকু নারীর?
হাবীবাহ নাসরীন-
পৃথিবীকে সুন্দর রাখতে যতটুকু অবদান পুরুষের, নারীর অবদান যেন তার থেকেও কিছু বেশি। স্বয়ং স্রষ্টাই নারীকে আরও বেশি মমতায় পূর্ণ করেছেন, দিয়েছেন অধিক ধৈর্য। আর একারণেই সম্মান ও ভালোবাসার জায়গাটা নারীর জন্য কিছুটা বেশিই বরাদ্দ থাকার কথা। আসলেই তা হচ্ছে কি? প্রতিবছর বিশ্বজুড়ে নারী দিবস পালন করা হয়। নানা প্রতীজ্ঞা, পদক্ষেপ নেওয়ার পরেও আমরা দেখতে পাই সেই পুরোনো চিত্র। নারীর নানাভাবে নির্যাতিত হওয়ার চিত্র পুরো বিশ্বেই পরিচিত। আধুনিক সময়ে, শিক্ষা ও শিল্পে অনেকটা অগ্রসর হয়েও নারীর প্রতি ভালোবাসা ও সহমর্মিতার অভাব যেন থেকেই যাচ্ছে।
চারপাশে তাকালে দেখতে পাই, পুরুষের কাছে নারী যতটা নির্যাতিত হচ্ছে, নারীর কাছ থেকেও তার কম হচ্ছে না! একটি মেয়ের গায়ের রং কালো হলে সবার প্রথমে তাকে যার কাছে কটু কথা শুনতে হয়, সে তার পরিবারেরই কোনো নিকটাত্মীয়া। নারী পড়াশোনা করে নিজের ক্যারিয়ার গড়তে চাইলে তাকে সবচেয়ে বেশি বাধাগ্রস্ত হতে হয় পরিবারের অন্যান্য নারী সদস্যদের কাছেই। ছোটবেলা থেকে নারীকে এই শুনে বড় হতে হয়- মেয়ে মানুষের এভাবে কথা বলতে নেই, এভাবে হাসতে নেই, এভাবে হাঁটতে নেই ইত্যাদি। এক্ষেত্রে লক্ষ্যণীয়- অগ্রজ নারী সদস্যরাই নিজেকে শুধু মানুষ না ভেবে ‘মেয়ে মানুষ’ হিসেবে মেনে নিচ্ছেন। এবং তাদের এই মেনে নেয়া বিষয়টি অনুজ নারী সদস্যদের ওপরেও চাপিয়ে দিচ্ছেন। ছোটবেলা থেকেই নিজেকে মানুষ না ভেবে ‘মেয়ে মানুষ’ ভাবা মেয়েটি তাই বড় হয়ে সেই জড়তা আর কাটাতে পারে না। সে শুধু চুপ থেকে নির্যাতিত হতেই শেখে। অথচ নিজেকে মানুষ ভাবলে সে তার পক্ষে দাঁড়িয়ে কথা বলতে শিখতো।
আমাদের পরিবারগুলোতে ছেলে সদস্যকে বোঝানো হয়, বড় হয়ে তাকেই মা-বাবার দায়িত্ব নিতে হবে। মেয়েকে বোঝানো হয়, তাকে একটি ভালো বিয়ে দেয়ার জন্যই বড় করা হচ্ছে। বিয়ে জীবনের গুরুত্বপূর্ণ অংশ, সন্দেহ নেই। একটি সুখি সংসার সব মেয়েরই কাম্য হওয়া উচিত। কিন্তু জীবন সব সময় মসৃণ না-ও চলতে পারে। যেকোনো প্রতিকূল পরিস্থিতিতে মেয়েটি যেন সংসারের হাল ধরতে পারে, যেন মা-বাবা কিংবা স্বামী ও তার পরিবারকে সহযোগিতা করতে পারে, সেই সামর্থ্যটুকুও থাকা চাই। শিক্ষিত হওয়ার চেয়েও তাই নারীর স্বনির্ভর হওয়া জরুরি।
নারী নির্যাতন, ইভ টিজিং, ধর্ষণ ইত্যাদি বেড়ে যাওয়ার সবচেয়ে বড় কারণ হলো পারিবারিক সুশিক্ষার অভাব। এই অভাব দেখা যায় দোষী ব্যক্তির ক্ষেত্রে। যে পুরুষ এ ধরনের জঘন্য কাজে নিজের নামটি জড়ালো, খোঁজ নিয়ে দেখুন, সেই পুরুষ তার পরিবারেও নারীকে নির্যাতিত হতে দেখেছে। যেখান থেকে সে নিজেকে মানুষ হিসেবে নয়, ‘পুরুষ মানুষ’ হিসেবে ভাবতে শিখেছে। নারী যে তারই মা, বোন কিংবা প্রিয়তমার ভিন্ন ভিন্ন রূপ- সম্মানের সেই জায়গাটুকু নারীকে সে দিতে শেখে না। যে নারী গর্ভের নিকষ অন্ধকারে তাকে দশটি মাস ধরে লালন করে পৃথিবীর আলো দেখিয়েছেন, সেই নারীকে ন্যূনতম শ্রদ্ধা জানানোর মতো বিবেকবোধও তার তৈরি হয় না। আর এই ভালোবাসাহীনতা, শ্রদ্ধাহীনতার পেছনে পুরুষের চেয়েও বেশি দায়ী মনে হয় নারীকে। কারণ অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তারা নিজেই নিজেকে সম্মান করে না, ভালোবাসে না। পরিবারের অন্য সবার ভালোবাসা-ভালোলাগাকে গুরুত্ব দিতে গিয়ে নিজের ভালোলাগার কাজগুলোকে তারা ভুলে যায়। অথচ নিজেকে ভালোবাসা সবার আগে জরুরি।
নারী এখন স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে যাচ্ছে। শিক্ষিত হচ্ছে। সুদক্ষ হিসেবে নিজেকে গড়ে তুলছে। কর্মস্থলেও নিজের মেধা ও বুদ্ধিমত্তা দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। এত প্রাপ্তির পরেও দিনশেষে নারী নির্যাতন, নিপীড়নের ঘটনা কম নয় কেন? এর বড় কারণ হচ্ছে, নারী এগিয়ে যাচ্ছে বিচ্ছিন্নভাবে। যারা অনেক বেশি সুযোগ-সুবিধা পেয়ে বড় হচ্ছে, তাদের মধ্যেই কেউ কেউ হয়তো নিজেকে যোগ্য প্রমাণ করার সুযোগ পাচ্ছে। অন্যদিকে সুবিধাবঞ্চিত কিংবা কম সুবিধাপ্রাপ্ত নারী আটকা পড়ে যাচ্ছে সেই চিরচেনা চক্রে। নিজেকে প্রতিনিয়ত দুর্বল ভাবতে থাকে বলেই একটা সময় এই মিথ্যাটিই তাদের জীবনে প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়। অথচ প্রায় সব ধর্মই নারীকে করেছে সম্মানিত। যার গর্ভে সঞ্চারিত হয় পৃথিবীর ভবিষ্যৎ, মুখরিত হয় মানবসভ্যতা; যার মমতা ও ভালোবাসায় রঙিন হয়ে ওঠে মানবজীবন- তাকে দুর্বল ভাবার কোনো সুযোগ নেই। আর নারীর এই শক্তিকে সবার আগে চিনতে শিখতে হবে নারীকেই।