ইসলাম ধর্মের ইতিহাসে বিবি খাদিজা
যুক্তরাজ্যের ম্যানচেস্টার শহরের একজন ইমাম বলছিলেন, ‘বিবি খাদিজা আক্ষরিক অর্থেই তার বিকাশের পথে অদৃশ্য বাধার দেয়াল ভেঙে দিয়েছিলেন। তিনি ১৪০০ বছর আগে যা অর্জন করেছিলেন, তা আজকের দিনেও হতে পারে একজন নারীর আকাঙ্খার বিষয়।’
তিনি ছিলেন ধনী এবং ক্ষমতাশালী, একজন সম্মানিত ব্যক্তিত্ব। সে যুগের অনেক নামী ও সম্ভ্রান্ত পুরুষ তাকে বিয়ে করতে চেয়েছিলেন, তিনি তিনি সাড়া দেননি।
শেষ পর্যন্ত তিনি অবশ্য বিয়ে করেছিলেন, দু’বার। তার প্রথম স্বামী মারা গিয়েছিলেন, আর তার দ্বিতীয় স্বামীর সাথে তার বিচ্ছেদ হয়েছিল বলে ধারণা করা হয় ।
এরপর তিনি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন আর বিয়ে করবেন না, যতদিন পর্যন্ত না সেই মানুষটির সাথে তার পরিচয় হয়েছিল, যিনি হবেন তার তৃতীয় এবং শেষ স্বামী।
মি. জামান বলছিলেন, সেই মানুষটির মধ্যে বিবি খাদিজা এমন কিছু অসামান্য গুণাবলী দেখেছিলেন, যা বিয়ে সম্পর্কে তার মনোভাব বদলে দেয়।
তাকে বেছে নেয়া এবং বিয়ের প্রস্তাব দেয়া -দুটিই করেছিলেন খাদিজা নিজেই। সে যুগে যেটা খুব স্বাভাবিক ব্যাপার ছিল না।
খাদিজার বয়স তখন ৪০। আর তার ভবিষ্যৎ স্বামী ছিলেন ২৫ বছর বয়সের সাধারণ পরিবার থেকে আসা এক যুবক। কিন্তু এটা কোন প্রেমের গল্প নয়, বরং তার চেয়ে অনেক বেশি কিছু।
এটি হচ্ছে পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম ধর্মের সূচনার কাহিনী। খাদিজার সেই নতুন স্বামী আর কেউ নন, তিনি পরবর্তীকালের ইসলামের নবী মুহাম্মদ।
‘ব্যবসায়ী’
নিউইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ে মধ্যপ্রাচ্যের প্রাচীন ইতিহাসের অধ্যাপক রবার্ট হোইল্যান্ড বলছেন, খাদিজা কে ছিলেন তার সম্পর্কে একটা বিস্তারিত চিত্র পাওয়া খুবই কঠিন।
তিনি বলছেন, এর একটা কারণ হলো, তার সম্পর্কে যা লেখা হয়েছে তার সবই তার মৃত্যুর বহু বছর পরে লিখিত।
হোইল্যান্ড বলেন, ‘তবে বেশিরভাগ সূত্রই আভাস দিচ্ছেন যে, খাদিজা ছিলেন স্বাধীন চেতনা এবং অত্যন্ত দৃঢ় ইচ্ছাশক্তিসম্পন্ন এক নারী’।
এর দৃষ্টান্ত হিসেবে বলা যায়, তিনি তার সম্পর্কীয় ভাইদের বিয়ে করতে অস্বীকার করেছিলেন। সে সময়কার ঐতিহ্য অনুযায়ী তার পরিবার এটাই চেয়েছিল।
কিন্তু খাদিজা চেয়েছিলেন, তিনি নিজেই তার জীবনসঙ্গী বেছে নেবেন। খাদিজা ছিলেন একজন ব্যবসায়ীর কন্যা। তার পিতা তার পারিবারিক ব্যবসাকে এক বাণিজ্যিক সাম্রাজ্যে পরিণত করেছিলেন।
এক যুদ্ধে তিনি নিহত হন। তার পর ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করেন খাদিজাই।
বিবিসির তৈরি একটি প্রামাণ্যচিত্রে ইতিহাসবিদ ও লেখক বেটানি হিউজ বলেন, ‘স্পষ্টতই তিনি তার নিজের পথ নিজে তৈরি করে নিতে অভ্যস্ত ছিলেন’।।
‘প্রকৃতপক্ষে তার এই যে ব্যবসায়িক দক্ষতা, এটাই তাকে এমন এক জায়গায় নিয়ে গিয়েছিল যা শেষ পর্যন্ত পৃথিবীর ইতিহাস বদলে দেয়’।
‘সহকারী’
খাদিজা তার কার্যক্রম পরিচালনা করতেন মক্কা থেকে। তার ব্যবসার জন্য অনেক পণ্যবাহী যানের কাফেলা দরকার হতো, যা দিয়ে তিনি মধ্যপ্রাচ্যের সবচেয়ে বড় শহরগুলোর মধ্যে পণ্য আনা-নেয়ার কাজ করতেন।
বেটানি হিউজ বলেন, ‘স্পষ্টতই তিনি তার নিজের পথ নিজে তৈরি করে নিতে অভ্যস্ত ছিলেন’।
এই সব কাফেলাগুলো দক্ষিণ ইয়েমেন থেকে সিরিয়া পর্যন্ত বিশাল এক অঞ্চল জুড়ে চলাচল করতো।
যুক্তরাজ্যের লিডস বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামের ইতিহাসের অধ্যাপক ফোজিয়া বোরা বলেছেন, খাদিজার সম্পত্তির একটা অংশ এসেছিল তার পরিবার থেকে, কিন্তু তিনি নিজেও বিপুল বিত্তের মালিক হয়েছিলেন। তিনি নিজের যোগ্যতাতেই একজন অত্যন্ত আত্মবিশ্বাসী ব্যবসায়ী হয়ে উঠেছিলেন।
তিনি তার কর্মচারীদের নিয়োগ করতেন নিজেই। তার ব্যবসার জন্য কাজে লাগবে এমন বিশেষ দক্ষতাসম্পন্ন লোকদের খুঁজে নিতেন তিনি।
খাদিজা একজন লোকের কথা শুনেছিলেন যার অত্যন্ত সৎ এবং পরিশ্রমী বলে সুনাম ছিল। তার সাথে সাক্ষাতের পর সন্তুষ্ট হয়ে তিনি তাকে তার একটি কাফেলার দায়িত্ব দিলেন।
লোকটির ঐকান্তিকতা খাদিজার প্রশংসা পেলো এবং কিছুকাল পরে তিনি এতটাই মুগ্ধ হলেন যে তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন, তিনি আবার বিয়ে করবেন।
ফোজিয়া বোরা বলছিলেন, ‘ইসলামের ভবিষ্যৎ নবী, যিনি ছোট বেলায় বাবা-মাকে হারানোর পর চাচার পরিবারে বড় হয়েছিলেন। তিনি সহসা এমন এক জীবনে প্রবেশ করলেন যেখানে অধিকতর স্থিতিশীলতা এবং অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি আছে।
জানা যায় যে এই দম্পতির মোট চারটি সন্তান হয়েছিল, তবে শুধু মাত্র কন্যাসন্তানরাই শৈশব পার হয়েছিল।
এই বিয়ের আরো একটি দিক ছিল যা সেই সময়ের তুলনায় অনন্য।
লন্ডনের মুসলিম ইনস্টিটিউটের রানিয়া হাফাজ বলেন, ‘এটি ছিল একটি ‘মনোগ্যামাস’ বিবাহ, অর্থাৎ যে বিয়েতে স্বামীর একজনই মাত্র স্ত্রী। সমাজবিজ্ঞানের দৃষ্টিতে দেখতে গেলে সেটা ছিল ‘পলিগ্যামি’র সমাজ অর্থাৎ তখনকার বেশিরভাগ পুরুষেরই একাধিক স্ত্রী থাকতো। সেদিক থেকে এটা খুবই ব্যতিক্রমী।’
‘প্রথম প্রত্যাদেশ’
ইসলামের নবীর জন্ম হয়েছিল কুরাইশ গোষ্ঠীতে, খাদিজারও ছিল তাই। সে সময় ওই এলাকার বিভিন্ন গোষ্ঠী নানা রকম দেবতার উপাসনা করতো।
বিয়ের কয়েক বছর পর ভবিষ্যৎ নবীর জীবনে কিছু আধ্যাত্মিক পরিবর্তন আসতে থাকে। তিনি মক্কার বাইরের পর্বতে ধ্যান করতে যেতেন।
ইসলামী বিশ্বাস অনুযায়ী তিনি আল্লাহর প্রত্যাদেশ পান জিব্রাইলের কাছ থেকে। ইনিই সেই ফেরেশতা যিনি মেরির কাছে ঘোষণা করেছিলেন যে তিনি যীশুর মা হতে যাচ্ছেন। এ ভাবেই মুসলমানদের পবিত্র গ্রন্থ কোরান অবতীর্ণ হয়।
বলা হয়, নবীর কাছে প্রথম প্রত্যাদেশ আসার পর তিনি ভয় পেয়েছিলেন, কারণ তিনি বুঝতে পারছিলেন না যে কি ঘটছে।
ফোজিয়া বোরা বলছিলেন, ‘তার যে অভিজ্ঞতা হচ্ছিল তা তিনি বুঝতে পারছিলেন না। কারণ তিনি একেশ্বরবাদী ধর্ম সম্পর্কে পূর্বপরিচয় আছে এমন পরিবেশে বেড়ে ওঠেন নি,’
অধ্যাপক হোইল্যান্ড বলেন, ‘এসব ঘটনায় তিনি অত্যন্ত বিভ্রান্ত এবং মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়লেন। বিভিন্ন সূত্রে বলা হয়, এসব প্রত্যাদেশ সহজ ছিল না এবং এ অভিজ্ঞতা শান্ত হলেও শারীরিকভাবে তা ছিল অপ্রত্যাশিত। তিনি ঠিক করলেন, এ অভিজ্ঞতা তিনি তার সবচেয়ে বিশ্বস্ত মানুষটিকে বলবেন’।
খাদিজা ব্যাপারটা শুনলেন এবং তাকে শান্ত করলেন। তিনি তার সহজ বুদ্ধি দিয়েই বুঝেছিলেন যে যা হচ্ছে তা ভালো কিছুই হচ্ছে, এবং তিনি তার স্বামীকে আশ্বস্ত করলেন।
খাদিজা এমনকি তার একজন আত্মীয়ের পরামর্শ চাইলেন, যার খ্রিস্টান ধর্ম সম্পর্কে জানাশোনা ছিল। এই ওয়ারাকা ইবনে নওফাল নবীর পাওয়া প্রত্যাদেশগুলোকে নবী মুসা যা পেয়েছিলেন তার সাথে সম্পর্কিত করলেন।
বোরা বলছিলেন, ‘আগেকার কিতাবগুলো সম্পর্কে তার জানা ছিল, এবং সে কারণেই ইসলামের নবীর পাওয়া প্রত্যাদেশগুলোর যথার্থতার নিশ্চয়তা মিলেছিল তার কাছ থেকে’।
হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক এবং ইসলাম বিষয়ে বিশেষজ্ঞ লাইলা আহমেদ বলেন, ‘আমরা জানি যে যখন কোরান অবতীর্ণ হচ্ছিল তখন নবীও নিজের ব্যাপারে সংশয়ে ছিলেন। কিন্তু খাদিজাই তাকে আশ্বস্ত করেন যে তিনি আসলেই একজন নবী’।
বাণী প্রথম শুনলেন
বিশেষজ্ঞরা একমত যে খাদিজাই নবীর প্রাপ্ত কোরানের বাণী প্রথম শুনেছিলেন।
ফোজিয়া বোরা বলেন, তিনি এই বার্তা বিশ্বাস এবং গ্রহণ করেছিলেন। এটা নিশ্চয়ই নবীকে আত্মবিশ্বাস দিয়েছিল এবং তাকে সেই বার্তা প্রচার করার কণ্ঠ দিয়েছিল।
ইতিহাসবিদ বেথানি হিউজ বলছেন, এই পর্যায়ে এসে ইসলামের নবী বিভিন্ন গোষ্ঠীর নেতাদের চ্যালেঞ্জ করেন এবং প্রকাশ্যে এ বার্তা প্রচার করার সিদ্ধান্ত নেন যে, ‘আল্লাহই হচ্ছেন একমাত্র উপাস্য এবং অন্য কারো উপাসনা হচ্ছে ধর্মদ্রোহিতা।’
ফোজিয়া বোরা বলছিলেন, ইসলাম প্রচার শুরুর সময় নবীকে একঘরে করে দিয়েছিলেন মক্কার সমাজের অনেকেই, যারা এক আল্লাহয় বিশ্বাসের বিরোধী ছিলেন।
ফোজিয়া বোরা বলছিলেন, ‘কিন্তু খাদিজা তাকে সেই সমর্থন এবং সুরক্ষা দিয়েছিলেন, যা নবীর তখন অত্যন্ত প্রয়োজন ছিল’।
হিউজ বলেন, ‘পরবর্তী ১০ বছরে খাদিজা তার স্বামীকে সমর্থন দেয়া এবং সেই নতুন ধর্ম সম্প্রদায়ের জন্য অর্থের ব্যবস্থা করতে, তার সমস্ত সম্পদ এবং পারিবারিক যোগাযোগগুলোকে ব্যবহার করেছিলেন।’
হিউজ বলছিলেন, ‘সে সময়কার বহু-ঈশ্বরে বিশ্বাসী সমাজে এক আল্লাহ-বিশ্বাসের ওপর গড়ে ওঠা ইসলাম ছিল এক বিতর্কিত ধর্ম।’
শোকের বছর
খাদিজা তার স্বামী এবং ইসলাম ধর্মকে সহায়তা দিতে তার সাধ্যমত সব কিছুই করেছিলেন, কিন্তু ৬১৯ সালে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং মারা যান।
একসাথে ২৫ বছর কাটানোর পর ইসলামের নবী এই মৃত্যুতে একেবারেই বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন।
অধ্যাপক হোইল্যান্ড বলেন, খাদিজার মৃত্যুর শোক তিনি কখনোই কাটিয়ে উঠতে পারেননি। তখনকার দিনের সূত্রগুলো যেভাবে খাদিজা সম্পর্কে কথা বলেছেন, তা সত্যি চমকপ্রদ। তাদের কথায়, নবীর সবচেয়ে বড় বন্ধু ছিলেন খাদিজা। তার ঘনিষ্ঠতম সঙ্গী আবু বকর বা ওমরের চাইতেও বেশি।
ইতিহাসবিদ বেটানি হিউজ বলেন যে মুসলিমরা খাদিজার মৃত্যুর বছরটিকে এখনো শোকের বছর হিসেবে উল্লেখ করেন।
ইসলামের নবী অবশ্য এর পরে আরো অনেকবার বিবাহ করেছিলেন। খাদিজাকে নিয়ে একটি বই লিখেছেন ইসলাম বিশেষজ্ঞ ফাতিমা বরকতুল্লাহ।
বিবিসির এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, খাদিজা সম্পর্কে আমরা যতটুকু জানি তার বেশির ভাগেরই উৎস বিভিন্ন হাদিস, যা ইসলামের নবীর উক্তি, ও তার জীবনের নানা কাহিনীর সংকলন।
নবীর সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ অনুসারীরা এগুলো বলেছেন এবং মনে রেখেছেন, যা পরে লিপিবদ্ধ করা হয়। হাদিসের বর্ণনাকারীদের একজন হচ্ছে বিবি আয়শা, নবীর অন্যতম স্ত্রী এবং ইসলামের ইতিহাসে একজন প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব।
ফাতিমা বরকতুল্লাহ বলছেন, এটা খুবই স্বাভাবিক যে নবী তাকে খাদিজার গল্প, এবং তার নবী হয়ে ওঠার সময়কার কথা বলেছিলেন। বিবি আয়শা যদিও নবীর জীবনের আগেকার পর্ব নিজ চোখে দেখেননি কিন্তু তিনি অন্য মুসলিমদের সেগুলো জানানোর মাধ্যমে তার কর্তব্য বিশ্বস্তভাবেই পালন করেছিলেন’।
এক অনন্য দৃষ্টান্ত
ফোজিয়া বোরা বলছিলেন, খাদিজার ইতিহাস জানাটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ প্রথম দিককার মুসলিম সম্প্রদায়গুলোর মধ্যে নারীদের ঘরে বন্দী করে রাখা হতো এমন যেসব ভুল ধারণা আছে, তা ভাঙার জন্য এটাই খুবই প্রয়োজনীয়।
তিনি বলেন, ‘খাদিজা যা করতে চাইতেন তা থেকে বিরত থাকতে কখনো বলেননি নবী। প্রকৃতপক্ষে সেই সময়ের তুলনায় ইসলাম নারীদের অনেক বেশি অধিকার ও গুরুত্ব দিয়েছে’।
ফোজিয়া বোরা বলেন, ‘একজন ইতিহাসবিদ এবং মুসলিম হিসেবে আমার কাছে খাদিজা, আয়শা এবং নবীর মেয়ে ফাতিমাসহ অন্য নারীরা অনুপ্রেরণা দেবার মত ব্যক্তিত্ব। তারা ছিলেন বুদ্ধিজীবী, রাজনৈতিকভাবে সক্রিয়, ধর্ম প্রচার ও ইসলামী সমাজকে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে তারা বিরাট ভূমিকা পালন করেছেন।”
তিনি বলছেন, ‘আমার জন্য এটা একটা দারুণ ব্যাপার যে আমার ছাত্রছাত্রীদেরকে, তারা মুসলিম বা অমুসলিম যাই হোক, আমি এই নারীদের সম্পর্কে শিক্ষা দান করতে পারছি’। বিবিসি