শনিবার, ৩ অক্টোবর ২০২০
প্রথম পাতা » » ‘ধর্ষিত সমাজে’ নারীরা কোথায় যাবে?
‘ধর্ষিত সমাজে’ নারীরা কোথায় যাবে?
হৃদয় আলম-
করোনাভাইরাসের পাশাপাশি নারী নির্যাতন ও ধর্ষণও যেন বাংলাদেশে মহামারি হয়ে দেখা দিয়েছে। এমন কোনো দিন নেই যেদিন সংবাদপত্রে ৪-৫টি ধর্ষণের ঘটনার খবর প্রকাশিত হচ্ছে না। দেশে গত এক সপ্তাহে সংঘটিত বেশ কয়েকটি ধর্ষণের ঘটনা ও ঘটনার ধরন জনমনে ব্যাপক শঙ্কার সৃষ্টি করেছে। ধর্ষকের নিপীড়নের হাত থেকে বাদ যায়নি প্রতিবন্ধী কিশোরী, এমনকি ছয় বছরের শিশুও। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে পরিবারের সদস্যদের কাছ থেকে ভিক্টিমকে ছিনিয়ে নিয়ে দলবদ্ধ ধর্ষণ ও হত্যার ঘটনায় শঙ্কা জানিয়ে মানবাধিকারকর্মী ও অ্যাক্টিভিস্টরা বলছেন, বিচারহীনতার সংস্কৃতি এবং বিচার প্রক্রিয়া নারীবান্ধব করতে না পারার কারণেই ধর্ষকরা নিজেদের অপ্রতিরোধ্য ভাবছে। এমন পরিস্থিতিতে স্বাভাবিকই প্রশ্ন ওঠে নারীরা আসলেই সমাজে নিরাপদ কীনা। বা এই ‘ধর্ষিত সমাজে’ নারীরা কোথায় যাবে।
ধর্ষণের মতো ঘৃণ্য অপরাধের শাস্তি অনেক দেশে মৃত্যুদণ্ড হলেও আমাদের দেশে এই ঘৃণ্য অপরাধটাই সাধারণ ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ নেই, প্রতিরোধ নেই, নেই আইন কার্যকর করার কোনো বিশেষ ব্যবস্থা। ক্ষমতার দাপট, বিচারহীনতার সংস্কৃতি এবং বিচার প্রক্রিয়া নারীবান্ধব করতে না পারাসহ সামাজিক-রাজনৈতিক উদাসীনতার সুযোগে ধর্ষকরা বেপরোয়া হয়ে উঠেছে।
বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের এক হিসাবে দেখা গেছে, কেবল গত আগস্ট মাসেই ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ২৪৯ জন নারী ও শিশু। এরমধ্যে দলবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ৩২ জন।
অপরদিকে সেপ্টেম্বরের বেশ কয়েকটি ধর্ষণের ঘটনা দেশজুড়ে চাঞ্চল্যের তৈরি করেছে-
১৬ সেপ্টেম্বর ঢাকার সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে স্বামীর জন্য রক্ত জোগাড় করতে এসে ধর্ষিত হয়েছেন এক নারী।
১৮ সেপ্টেম্বর নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জের কদমতলী এলাকায় অষ্টম শ্রেণির এক ছাত্রীকে (১৪) ধর্ষণ করেছে তার ‘প্রাইভেট শিক্ষক’ মাজহারুল ইসলাম রায়হান।
২২ সেপ্টেম্বর চাঁদপুরের ফরিদগঞ্জ উপজেলায় নিজের মেয়েকে ধর্ষণ করেছেন মনির হোসেন নামের এক ব্যক্তি। মেয়ের মা বাদী হয়ে নিজের স্বামীর নামে মেয়েকে ধর্ষণের মামলা করেছেন।
২৩ সেপ্টেম্বর খাগড়াছড়িতে ডাকাতি করতে ঘরে ঢুকে এক প্রতিবন্ধী তরুণীকে দলবেঁধে ধর্ষণ করা হয়েছে।
বুধবার, ২৩ সেপ্টেম্বর গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জে এক তরুণীকে (২০) দুইদিন ধরে আটকে রেখে দলবেঁধে ধর্ষণ করা হয়েছে।
২৫ সেপ্টেম্বর পিরোজপুরের মঠবাড়িয়া উপজেলায় দুই ভাশুরের হাতে ধর্ষিত হন এক নারী। তার স্বামী ও শাশুড়ি তাকে এ বিষয়ে বাড়াবাড়ি না করার জন্য বলেছেন।
২৫ সেপ্টেম্বর সিলেটের এমসি কলেজে স্বামীকে আটকে রেখে স্ত্রীকে দলবেঁধে ধর্ষণ করা হয়েছে। এর সাথে জড়িত ছাত্রলীগের নেতা-কমীরা।
২৬ সেপ্টেম্বর কাজ দেওয়ার নামে ডেকে নিয়ে এক নারীকে ধর্ষণ করা হয় কেরানীগঞ্জ মডেল টাউন এলাকায়।
১০-২৪ সেপ্টেম্বরের মধ্যে বান্দরবানের লামায় এক পাহাড়ি নারীকে দলবেঁধে ধর্ষণ, অষ্টম শ্রেণির ছাত্রীকে দলবেঁধে ধর্ষণ, তাইদং খওয়া পাড়ায় পাহাড়ি কিশোরীকে ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে।
২০ থেকে ২৬ সেপ্টেম্বর রাজধানীর ভাটারা থানা এলাকায় চার কিশোরীকে আটকে রেখে ধর্ষণে অভিযোগ পাওয়া গেছে এক কিশোরের বিরুদ্ধে। টিকটক ও লাইকির জন্য ভিডিও বানানোর কথা বলে ১৬ থেকে ২০ সেপ্টেম্বরের মধ্যে পাঁচ কিশোরী বাসায় ডেকে আনে হৃদয় নামের ওই অভিযুক্ত। এরপর তাদের ২৬ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত আটকে রেখে দফায় দফায় ধর্ষণ করা হয়।
ধর্ষণের ঘটনায় এখনই ধর্ষকদের যথাযথ বিচার না হলে ভবিষ্যতে এটি সামাজিক ব্যাধি হয়ে দাঁড়াবে বলে মত মানবাধিকার সংগঠনগুলোর। তারা বলছেন বেশিরভাগ ঘটনার সাথেই প্রভাবশালী বা ক্ষমতাসীল দলের নেতাকর্মীরা যুক্ত থাকেন বলে অভিযুক্তরা সহজেই পার পেয়ে যান। আর এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটে।
মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) হিসাব অনুযায়ী, ২০১৯ সালে এক হাজার ৪১৩ জন নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। ২০১৮ সালে এই সংখ্যা ছিলো ৭৩২ জন। অর্থাৎ আগের বছরের তুলনায় গত বছর ধর্ষণের ঘটনা বেড়েছে দ্বিগুণ যা ভয়াবহ বলে উল্লেখ করেছে সংস্থাটি। ২০১৭ সালে ধর্ষণের শিকার হন ৮১৮ জন নারী। ২০১৯ সালে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ৭৬ জনকে। আর আত্মহত্যা করতে বাধ্য হয়েছেন ১০ জন নারী।