জলোচ্ছ্বাস গেলেও, যায়নি ক্ষতচিহ্নের দাগ
আমজাদ হোসেন আমু-
লক্ষ্মীপুর প্রতিনিধি : মাত্র কয়েক দিন আগের কথা, হঠাৎ জলোচ্ছ্বাসে মেঘনা নদী এলাকার আশেপাশে পানি আর পানিতে ভরে গেছে। স্বাভাবিকের চেয়ে ৫-৬ ফুট পানিতে তলিয়ে গেছে লক্ষ্মীপুরের রামগতি- কমলনগরের প্রায় ত্রিশ গ্রাম।
জলোচ্ছ্বাসে ভেসে গেছে নদীতীরের গ্রাম, উপকূলের বাড়ি-ঘর। ঘরের ভেতর কোমড় সমান পানি ৷ পোকামাকড়, সাপ, বিচ্চুর ভয়। তবুও বেঁচে থাকতে হয়। কারণ, ঝড়-ঝঞ্ঝা, জলোচ্ছ্বাসের ঝাপটার মাঝেই যে বেঁচে থাকতে শিখে গেছে মেঘনার উপকূলীয় মানুষ। তাদের চোখে এখন আর ভয় নেই।
গত ৫ আগস্ট লক্ষ্মীপুরের মেঘনাতীরের ৬০ কিলোমিটার এলাকায় জুড়ে যে মাঝারি জলোচ্ছ্বাস হয়েছিল, এতে কোটি কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। মেঘনার পাড়ে যেখানে চোখ যায় সেখানেই ক্ষতির চিহ্ন চোখে পড়ছে। প্রায় শত পুকুর আর জলাশয়ের চাষের সব মাছ পুকুর থেকে বেরিয়ে গেছে। এতে মৎস্য চাষীদের অর্ধ কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এছাড়াও মুরগী, হাঁস, গরু, ছাগল, বেড়া খামারিদেরও অর্ধ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে।
জলোচ্ছ্বাসে কেউ ঘর হারিয়েছে। কেউ ঘরের আলমিরা, স্বর্ণালংকার হারিয়েছেন, কেউ হারিয়েছেন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। আবার কেউ বা হারালেন চলাচলের একমাত্র পথটি। জলোচ্ছ্বাসে ক্ষত-বিক্ষত মেঘনাতীরের পথ ধরে হাঁটলে সবখানেই কম বেশি এ ক্ষতটা চোখে পড়ে। তবে প্রতিবেদকের চোখে জলোচ্ছ্বাসে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকাগুলোর মধ্যে লক্ষ্মীপুরের রামগতি ও কমলনগর উপজেলাতে ক্ষতের চিহ্নটাই একটু বেশি। কমলনগরের চর মার্টিনের ৮নং ওয়ার্ড ঘুরে দেখা যায়, জলোচ্ছ্বাসের তান্ডবে পুরো ওয়ার্ডের রাস্তা-ঘাটগুলো তছনছ হয়ে গেছে।
স্থানীয়দের মতে, বেড়িবাঁধ না থাকায়, মেঘনার পানি বেড়ে উঠে তীরে এমন জলোচ্ছ্বাস হয়েছে। প্রায় ৬ ফুট উচ্চতার এমন জলোচ্ছ্বাস গত ২০বছরেও দেখেনি কেউ। তারা বলছেন, জোয়ারের পানি কয়েক মিনিটের মধ্যেই তীরে আঘাত হানে এবং মুহুর্তেই উপকূলীয় অঞ্চলে কয়েক কিলোমিটার এলাকাব্যাপী তান্ডব চালায়।
কমলনগরের তোরাবগন্জ, মতিরহাট, মাতাব্বরহাট, লধুয়া বাজার সড়কের উপর দিয়ে পানির স্রোত বয়ে গেছে। এতে সাধারণ জনগন চলাচলে ব্যাপক ঝুঁকি কাজ করছে। পথচারিদের যানবাহন চলছে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে। চর মার্টিনের বলিরপোল থেকে চর কালকিনির নাছিরগঞ্জ নির্মাণধীন সড়কটির বিভিন্ন অংশ ভেঙে গেছে জলোচ্ছ্বাসের প্রবল স্রোতে। ভাঙাচোরা এ সড়ক যেন এখন মরণফাঁদ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
জলোচ্ছ্বাসের খবর কাভার করতে নদীপাড়ে গেলে দেখা যায়, বহু মানুষের ভিটি থেকে মাটি সরে গেছে। ঘরের গোছানো থালা-বাসন, সবটাই জোয়ারের তোড়ে ভেসে গেছে। চোখে পড়ে, কেউ কেউ জোয়ারে ভেসে যাওয়া পুকুরের মাছ আটকাতে না পেরে অঝোরে কাঁদছেন। যেন সব চোখে ভাসছে এখনো। নদীতীরের বিভিন্ন স্থানে বেড়িবাঁধ ভেঙেছে। সে সব বেড়িবাঁধ মেরামতে এখনো কোন উদ্যোগ চোখে পড়েনি। ফলে অনেকের যোগাযোগের মাধ্যম হয়ে উঠছে খেয়া পারাপার।
এ দিকে জোয়ারের পানিতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে কৃষকের ফসলি জমি। ক্ষতি হয়েছে কয়েক হাজার হেক্টর আউশের চাষ । নষ্ট হয়েছে আমন বীজ।
কৃষক ইসমাইল হোসেন জানান, জলোচ্ছ্বাসে যে ক্ষতি হয়েছে তা অপূরণীয়। বিগত কয়েক দশকের ঘূর্ণিঝড়েও এমন ক্ষতির মুখে পড়েনি তারা। সরকার বা কারো কাছ থেকে ক্ষতিপূরণের তেমন একটা উদ্যোগও দেখা যায়নি।
মৎস্য চাষী চর ফলকন ইউনিয়নের মো. বাহার জানান, হঠাৎ মেঘনা নদীর পানি বেড়ে তার দুটি পুকুরের প্রায় ৫০ হাজার টাকার মাছ বের হয়ে গেছে। তার প্রায় লাখ টাকার মত ক্ষতি হয়েছে।
এদিকে ক্ষতিগ্রস্ত রাস্তাঘাটগুলো দ্রুত দাবি জানিয়েছেন চলাচলকারী যাত্রী ও মানুষজন। তারা বলছেন, মেঘনাতীর হওয়াতে এ অঞ্চলটা নদী কেন্দ্রিক অর্থনীতি নির্ভর। বিশেষ করে ইলিশের বাজারজাতকরণে সড়কগুলো বড় ভূমিকা রাখে৷ সড়কগুলোর এমন বেহাল দশাতে ব্যবসায় বড় ধরণের ক্ষতি দেখছেন ইলিশ ব্যবসায়ীরা।
চর কালকিনি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মাস্টার সায়েফ উল্লাহ বলেন, আমার ইউনিয়নের অধিকাংশ এলাকা নদীগর্ভে বিলীন। নদীতে বেড়িবাঁধ না থাকায় নদী প্রতিনিয়ত মানুষের ভিটে-মাটিতো বিলীন করছেই, পাশাপাশি একটু জোয়ার হলে পানিতে সব তলিয়ে যায়। মানুষদের দুর্ভোগের সীমা থাকে না।
কমলনগর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মেজবাহ্ উদ্দিন আহমেদ বাপ্পী বলেন, মেঘনা পানি বেড়ে উপকূলীয় অঞ্চলে মানুষের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। পুকুর বা জলাশয়ের মাছ এবং ঘর বাড়ি, ফসলি জমির ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। এতে সাধারন মানুষ আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়েছে।
তিনি আরও বলেন, উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা ও বিভিন্ন সামাজিক দপ্তরে বলা হয়েছে ক্ষতিগ্রস্তের নামের তালিকা করতে। যেন অন্তত কিছু করা যায়। বিশেষ করে মৎস্য চাষিদের তালিকা করা।
ভি-বানী / ডেস্ক