ওসি প্রদীপের যত কুকর্ম…
করোনাকালে ‘মানবিক পুলিশ’ আখ্যা পাওয়ার সফলতা ধূলিষ্যাৎ হয়ে যাচ্ছে কতিপয় বিতর্কিত-দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তার কারণে। পুলিশের গুলিতে সেনা বাহিনীর সাবেক মেজর সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খানের নিহত হওয়ার ঘটনা চরমভাবে প্রশ্নবিদ্ধ করে দিয়েছে পুলিশ বাহিনীকে। এ ঘটনায় টেকনাফ থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) প্রদীপ কুমারের বিরুদ্ধে এ ঘটনার অন্তরালে থাকাসহ বহু অভিযোগ শোনা যাচ্ছে।
আজ বুধবার দুপুরে মেজর সিনহার বড় বোন শারমিন শাহরিয়া ফেরদৌস কক্সবাজার জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে মামলা করেছেন। আসামি করা হয়েছে তাকে গুলি করা বাহারছড়া তদন্ত কেন্দ্রের ইনচার্জ পুলিশের উপ-পরিদর্শক (এসআই) লিয়াকত, টেকনাফ থানার ওসি প্রদীপ কুমার দাশসহ নয়জনকে। ধারণা করা হচ্ছে- এসব নিয়ে ফেঁসে যেতে পারে ওসিসহ সংশ্লিষ্ট পুলিশ সদস্যরা।
নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের দাবি- এখনই সময় বিতর্কিতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়ে পুলিশের মানবিক কাজের ধারা অব্যহত রাখা। কক্সবাজারের টেকনাফের ওসি প্রদীপ কুমারের নির্দেশেই প্রকাশ্যে এক অবসরপ্রাপ্ত মেজরকে গুলি করা ও তাঁর মৃত্যুর ঘটনায় দেশ জুড়ে বিতর্ক। টেকনাফের ভয়ংকর ওসি প্রদীপ মাদক নির্মূলের ঘোষণা দিয়ে কথিত বন্দুকযুদ্ধ দেখিয়েছে, সবকটিতে মাদক, অস্ত্র ও হত্যা তিনটি মামলা রুজি করে সে। একইভাবে সেনা কর্মকর্তার বিরুদ্ধে দুটি মামলা করা হয়। দেখানো হয় ৫০টি ইয়াবা, কিছু গাঁজা এবং দুটি বিদেশি মদের বোতল উদ্ধার দেখানো হয়।
এতে বাদ পরেনি এলাকার রাজনৈতিক নেতারাও। তাদের আসামি করে গ্রেফতার বাণিজ্য মেতে উঠে। তারপর মামলার চার্জশীট থেকে আসামী বাদ দেওয়ার অজুহাতে আদায় করে কোটি কোটি টাকা। তাছাড়া সে এখন টেকনাফের মহারাজা! থানায় মামলা নেয়া না নেয়া, আসামী ধরা ছাড়া, ইয়াবা ব্যবসায়ীদের মাসোহারা সহ সব মিলিয়ে মাসে শতকোটি টাকা আয় করেন এই ওসি। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান জানিয়েছেন পুরো ঘটনার নিরপেক্ষ তদন্ত চলছে। তদন্ত শেষ না হলে কিছু বলা যাবে না। ২০১৮ সাল থেকে এই পর্যন্ত কক্সবাজারের টেকনাফ থানায় ওসি প্রদীপ কুমারের নির্দেশে ১৪৪টি বন্দুকযুদ্ধের ঘটনা ঘটেছে, যেখানে মারা গেছেন ২০৪ জন সাধারণ মানুষ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলাদেশ পিস অবজারভেটরির জড়িপে এ তথ্য পাওয়া গেছে।
জানা গেছে, শুক্রবার সৈকত নগরী কক্সবাজারের শামলাপুরে পুলিশের চেক পোস্টে অবসরপ্রাপ্ত মেজরকে গুলি করা হয়। পুলিশের প্রাথমিক দাবি, তল্লাশির সময় তিনি আগ্মেয়াস্ত্র বের করেন। এরপরেই গুলি চালান এক রক্ষী। গুলি লেগে ঘটনাস্থলেই মৃত্যু হয় সেনা ওই কর্মকর্তার।
তদন্তে জানা গেছে সেনা বাহিনি থেকে অবসর নিয়ে সিনহা মহম্মদ রাশেদ খান কক্সবাজারের একটি হোটেলে থাকতেন। তাঁর পরিচিতরা দাবি করছেন, ইউটিউবের জন্য তথ্য চিত্র বানানোর কাজকে বেছে নিয়েছিলেন সিনহা রাশেদ। কেন তাঁকে গুলি করল পুলিশ এই প্রশ্নে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে চলছে তোলপাড়।
গত শুক্রবার রাতে কক্সবাজার-টেকনাফ মেরিন ড্রাইভ সড়কের শামলাপুর তল্লাশি চৌকিতে পুলিশের গুলিতে সিনহা রাশেদ খানের মৃত্যু হয়। পুলিশ জানিয়েছে, প্রাক্তন ওই সেনা কর্মকর্তা তাঁর ব্যক্তিগত গাড়িতে করে অপর একজন সঙ্গীসহ টেকনাফ থেকে কক্সবাজার আসছিলেন। মেরিন ড্রাইভ সড়কের বাহারছড়া চেকপোস্টে পুলিশ গাড়িটি থামিয়ে তল্লাশি করতে চাইলে সেনা কর্মকর্তা বাধা দেন।
সিনহার মা বলেছেন, একজন বীরের রক্ত বৃথা যেতে পারে না। আমার ছেলে মুক্তিযোদ্ধার সন্তান হয়েও নিজ দেশে এভাবে মারা যেতে হবে, তা তাঁরা কখনোই ভাবেননি। সিনহার মা তার ছেলের ব্যাচমেটদের জানিয়েছেন, টেকনাফ থেকে ওসি তাঁকে ফোনে তাঁর ছেলে সম্পর্কে বিভিন্ন খোঁজ খবর নিয়েছেন। কিন্তু মৃত্যুর সংবাদ তাকে জানানো হয়নি।
এ ঘটনায় টেকনাফ উপজেলার বাহারছড়া পুলিশ তদন্ত কেন্দ্রের দায়িত্বরত পরিদর্শক লিয়াকত আলীসহ সবাইকে প্রত্যাহার করা হয়েছে। রোববার দুপুরে তাঁদের প্রত্যাহার করে কক্সবাজার জেলা পুলিশ লাইনে নিয়ে আসা হয়েছে। কিন্তু এখনো বহাল তবিয়তে আছেন টেকনাফ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) প্রদীপ কুমার দাস।
কক্সবাজারের পুলিশ সুপার এবিএম মাসুদ হোসেন বলেন, ওই গাড়ির আরোহীদের ডাকাত সন্দেহ করে পুলিশকে খবর দেয় কয়েকজন। পুলিশ চেকপোস্টে গাড়িটি থামানোর চেষ্টা করে। কিন্তু গাড়ির আরোহী একজন পিস্তল বের করে পুলিশকে গুলি করার চেষ্টা করে। আত্মরক্ষার্থে পুলিশ গুলি চালায়। এতে ওই ব্যক্তি মারা যান। দুজনকে আটক করা হয়েছে। পুলিশ পিস্তলটি বাজেয়াপ্ত করেছে।
বাংলাদেশ সেনাবাহিনি জানাচ্ছে, সিনহা রাশেদ খান ২০১৮ সালে স্বেচ্ছায় অবসর গ্রহণ করেন। তিনি মেজর ছিলেন। তাঁর পিতা ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা ও অর্থ মন্ত্রকের প্রাক্তন উপসচিব।
মৃতের পরিচিতরা বলছেন, ঢাকার স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটির ফিল্ম অ্যান্ড মিডিয়া বিভাগের তিনজন ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে ট্রাভেল ভিডিও তৈরি করতে কক্সবাজার গিয়েছিলেন সিনহা রাশেদ খান। প্রায় এক মাস তারা কক্সবাজারের বিভিন্ন স্থানে শুটিং করেন। তাঁর বন্ধুরা এই ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত দাবি করে দোষীদেও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানিয়েছেন।
প্রতীপ কুমারের বিরুদ্ধে যত অভিযোগ: টেকনাফের এই প্রদীপ কুমার সেই ওসি যার বিরুদ্ধে পুলিশ হেডকোয়ার্টারে অনেকবার তার চাঁদাবাজী, স্বামীকে আটকে স্ত্রীকে ধর্ষণ, ইয়াবার নামে ব্যবসায়ীদের হয়রানী, মিথ্যা মাদক মামলায় ধনীদের ফাঁসিয়ে কোটি টাকা ঘুষ নেয়া অভিযোগ রয়েছে পুলিশ সদর দফতরে। ওসি প্রদীপ কুমার দাশ কক্সবাজারের বিভিন্ন পয়েন্টে জমি কিনে বাড়ি, গাড়ির মালিক হয়েছে। এমনকি সে ভারতের আসামের রাজধানী গৌহাটি শহরের পল্টন স্টেশনের পাশে অভিজাত দুটি বাড়ী করেছে। ২০১৮ সালে কক্সবাজার বিএনপির সভাপতি শাহজাহান চৌধুরীকে কক্সবাজার ছেড়ে চলে যেতে বলেছিলেন ওসি প্রদীপ কুমার দাশ। এলাকা না ছাড়লে গুলি দিয়ে মেরে ফেলার হুমকি দিয়েছিল ওসি। বিএনপির আমলে প্রভাবশালী এক মন্ত্রীর সুপারিশেই পুলিশে চাকরি পায় সে। চাঁদাবাজি করে টেকনাফের টর্চার সম্রাটে পরিণত হয়েছে। সিআইপি পদমর্যাদার একজন শিল্পপতিকে মিথ্যা মামলা দিয়ে হয়রানির অভিযোগে বায়েজিদ বোস্তামি থানার ওসি প্রদীপ কুমার দাশকে গত ১৬ নভেম্বর সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছিলো।
এদিকে বরখাস্ত থাকাকালীন ওসি প্রদীপের বডিগার্ডকে সঙ্গে নিয়ে নগরীর শপিং মলসহ বিভিন্ন এলাকায় ওসি প্রদীপকে চলাফেরা করেন। কোতোয়ালীর এসআই থাকাকালীন নগরীর পাথরঘাটায় এক হিন্দু বিধবা মহিলার জমি দখলের অভিযোগ রয়েছে প্রদীপ কুমার দাশের বিরুদ্ধে। এমনকি তার বিরুদ্ধে অভিযোগ থেকে পাঁচলাইশ থানা এলাকায় নিজের বোনের জমি দখলের অভিযোগটাও বাদ যায়নি। ২০১২ সালে আদালতের অনুমতি ছাড়া বন্দরে আসা একটি বিদেশি জাহাজকে তেল সরবরাহে বাধা, বার্জ আটক এবং ১৮ দিন পর বার্জ মালিকসহ ১২ জনকে বিশেষ ক্ষমতা আইনে মামলা দিয়ে হয়রানি ও অনৈতিক সুবিধা নেয়ার ঘটনায় ফেঁসে যান তৎকালীন পতেঙ্গা থানার ওসি প্রদীপ। অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ার পর ওসি প্রদীপকে পতেঙ্গা থানা থেকে প্রত্যাহার করা হয়। ২০১৩ সালের ২৪ জানুয়ারি ওসি প্রদীপের একটি মামলায় রিমান্ড আবেদনের বিরোধিতা করায় এক আইনজীবীকে লালদীঘির পাড় থেকে ধরে নিয়ে থানায় আটকে রাতভর নির্যাতন চালানো হয়। ২০১৩ সালের ২৪ মে পাঁচলাইশ থানার পাশের একটি কমিউনিটি সেন্টার থেকে শিবির আখ্যা দিয়ে ৪০ শিক্ষার্থীকে আটকের ঘটনায় ছাত্রলীগ-যুবলীগের তোপের মুখে পড়েন ওসি প্রদীপ। সে সময় ওসি প্রদীপের সঙ্গে ছাত্রলীগ-যুবলীগ নেতাকর্মীদের ব্যাপক বাকবিতন্ডার একপর্যায়ে তারা ওসিকে লাঞ্ছিত করে। পাঁচলাইশে ওসি থাকাকালীন বাদুরতলা এলাকায় বোরকা পরা এক বয়োবৃদ্ধাকে রাজপথে পিটিয়ে রক্তাক্ত জখম করে ব্যাপক সমালোচিত হন ওসি প্রদীপ। এ ঘটনার জানাজনি হলে পুলিশের ঊর্ধ্বতন মহলে টনক নড়ে। ওসি প্রদীপের বিরুদ্ধে বিভাগীয় তদন্ত করা হয়। এক পর্যায়ে ২০১৩ সালের ২১ আগস্ট তাকে পাঁচলাইশ থানা থেকে প্রত্যাহার করা হয়। মেজর রাশেদ সিনহাকে ক্রসফায়ারে হত্যা করে এসআই লিয়াকত। টেকনাফ থানায় যত ক্রসফায়ার হয় সব এই ওসির নির্দেশেই হয়।
মাঠে তদন্তে কমিটি: টেকনাফে পুলিশের গুলিতে অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা সিনহা রাশেদ খান নিহতের ঘটনায় তদন্তে মাঠে নেমেছে গঠিত তদন্ত কমিটি। গতকাল মঙ্গলবার সকালে কমিটির আহবায়ক চট্রগ্রাম বিভাগের অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার মোহাম্মদ মিজানুর রহমান এ তথ্য জানান।
তিনি বলেন, বিষয়টির তদন্ত চলছে। তদন্ত শেষে বিস্তারিত বলা যাবে।
গত শুক্রবার রতে কক্সবাজার-টেকনাফ মেরিন ড্রাইভের বাহারছড়া ইউনিয়নের শামলাপুর চেকপোস্টে পুলিশের গুলিতে নিহত হন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান। এ ঘটনায় পুলিশের বিবরণ নিয়ে প্রশ্ন ওঠায় প্রথমে কক্সবাজারের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট শাজাহান আলিকে আহ্বায়ক করে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয়। এরপর ২৪ ঘন্টা না পেরুতেই তদন্ত কমিটিকে শক্তিশালী করে পুনর্গঠন করা হয়। তাতে আগের কমিটির আহ্বায়ককে সদস্য রেখে যুগ্মসচিব পর্যায়ের চট্টগ্রাম বিভাগের অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার মোহাম্মদ মিজানুর রহমানকে নতুন আহ্বায়ক করা হয়।
রাশেদের মাকে প্রধানমন্ত্রীর ফোন: পুলিশের গুলিতে নিহত সাবেক সেনা কর্মকর্তার মা নাসিমা আক্তারকে ফোন করে সমবেদনা ও সান্তনা জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। গত মঙ্গলবার প্রধানমন্ত্রী তাকে ফোন করেন। মেজর রাশেদের মাকে এই ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচারের আশ্বাস দিয়েছেন বলে নিহত রাশেদের পরিবারের সদস্যরা জানিয়েছেন। তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী ফোন করেছিলেন। ছেলের মৃত্যুতে প্রধানমন্ত্রী সান্তনা ও সমবেদনা জানিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী আমাকে বলেছেন, আমিও একই পথের পথিক। আপনাকে কিছু বলার মতো ভাষা আমার নেই। আমিও পুরো পরিবার হারিয়েছি। সিনহার মা নাসিমা আক্তার বলেন, আমি প্রধানমন্ত্রীকে বলেছি, ছেলেকে ফিরে পাব না। আমি এই ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচার চাই। জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে বিচার হবে। এই ঘটনায় একটি গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনে সিনহার সঙ্গে থাকা সিফাত নামে এক যুবকের ভাষ্য দিয়ে বলা হয়েছে, কোনোরূপ জিজ্ঞাসাবাদ ছাড়াই মেজর (অব.) সিনহার বুকে একে একে তিনটি গুলি ছোড়েন পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ পরিদর্শক লিয়াকত আলী। অন্যদিকে টেকনাফ মডেল থানায় পুলিশের করা মামলায় উল্লেখ করা হয়েছে, সিনহা মো. রাশেদ হঠাৎ করে তাঁর কোমরের ডান পাশ থেকে পিস্তল বের করে গুলি করার জন্য উদ্যত হলে পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ লিয়াকত আলী নিজের এবং সঙ্গে থাকা অফিসার ফোর্সদের জানমাল রক্ষার জন্য চারটি গুলি করেন। সিনহা রাশেদকে ঢাকায় সামরিক কবরস্থানে দাফন করা হয়েছে।