বাংলা বানানে বিশৃঙ্খলার জন্য দায়ী কে?
মোহাম্মদ নূরুল হক
অত্যল্প-সংখ্যক ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীকে বাদ দিলে অধিকাংশ বাংলাদেশিরই মাতৃভাষা বাংলা। অথচ এই ভাষার শুদ্ধতা রক্ষায় পুরো জাতি প্রায় উদাসীন। বিশেষ করে, উচ্চশিক্ষিত ব্যক্তি ও সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের হাতে বাংলা বানানের বিশৃঙ্খলার বিষয়টি নিত্যনৈমত্তিক ঘটনা মাত্র। অথচ প্রতিবছর ফেব্রুয়ারি মাস এলেই এসব উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা ভাষাবিষয়ক বিভিন্ন সেমিনার-সভায় ভাষার শুদ্ধতা রক্ষার পাশাপাশি নির্ভুল বানানে লেখার পক্ষে জোরালো বক্তব্যও রাখেন। জাতিকে দেন পরামর্শ-উপদেশও। কিন্তু ফেব্রুয়ারি মাস পার হওয়ার সঙ্গে-সঙ্গেই তাদের মাতৃভাষাপ্রীতি কর্পূরের মতোই উবে যায়।
বানানে বিশৃঙ্খলার ক্ষেত্রে প্রথম অভিযোগ তুলতে হয় শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে। এরমধ্যে স্কুল-কলেজ থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত, সব শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানের প্রশ্নপত্রে থাকে বানান ভুলের ছড়াছড়ি। থাকে ভুলে ভরা বাক্য। বাদ যায় না সাধু-চলিত রীতির মিশ্রণও। দেশের খ্যাতিমান শিক্ষাবিদ-সাহিত্যিকদের হাতে সংকলিত-সম্পাদিত স্কুল-কলেজপর্যায়ের পাঠ্যবইও ভুল বানান ও গুরুচণ্ডালী দোষ থেকে রেহাই পায় না। এসব পাঠ্যবইয়ের ভূমিকা থেকে শুরু করে, বিভিন্ন অধ্যায়েও একই বাক্যে সাধু-চলিত রীতির শব্দ। চলিত ভাষায় রচিত পুরো রচনার মাঝেমাঝে একই বাক্যেই থাকে সাধু-চলিতরীতির মিশ্রণ।
দ্বিতীয় স্থানে থাকা প্রতিষ্ঠান হলো গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম। এসব মাধ্যমে এমনভাবে বাংলা-ইংরেজি-হিন্দির মিশ্রণ ঘটানো হয় যে, তাতে বোঝা যায় না—কোন শব্দটি কোন ভাষা থেকে নেওয়া হয়েছে। এসব শব্দের লেখ্যরূপে যেমন, তেমনি কথ্যরূপেও থাকে বিকৃতি। আর বিকৃত লেখ্যরূপ ও কথ্যরূপকে বর্তমানকালের ‘স্মার্ট’ রূপ হিসেবে উপস্থাপন করছে গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম। এসব মাধ্যমে যারা লেখালেখি কিংবা চাকরিসূত্রে যুক্ত রয়েছেন, তারা ভাষার ব্যাকরণ যেমন মানতে রাজি নন, তেমনি কোনো নিয়ম-নীতির প্রতিও তাদের কোনো শ্রদ্ধাবোধ নেই। পরন্তু দম্ভের সঙ্গে তারা দাবি করেন, ভাষা প্রবহমান। তাই কোনো নির্দিষ্ট নিয়মে-ছকে একে বেঁধে রাখা ঠিক নয়। মনের ভেতর কোনো ভাবের উদয় যেভাবে হবে, হুবহু সেভাবেই তারা সেই ভাব প্রকাশ করতে চান।
ভাষাদূষণের ক্ষেত্রে তৃৃতীয় স্থানে রয়েছে সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান। সরকারের বিভিন্ন দপ্তর-অধিদপ্তর ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের প্রজ্ঞাপন, অফিস আদেশ, সাইনবোর্ড, বিলবোর্ড লিখিত হয় ভুল বানান-ভুল বাক্যে।
গণমাধ্যম, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও সরকারি-বেরসরকারি প্রতিষ্ঠানে নির্বিচারে ভাষাদূষণের ঘটনা ঘটলেও দায়ীদের ব্যাপারে কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার খবর পাওয়া যায় না। এছাড়া এসব ভুল নিয়ে গণমাধ্যমে কিছু দিন পরপর প্রতিবেদন প্রকাশিত হলেও তাতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের টনক নড়ে না। পরন্তু বানান ভুল বা ভাষাদূষণের মধ্যে তারা তেমন কোনো দোষও খুঁজে পান না।
উল্লিখিত বিষয়গুলো পর্যালোচনা করলে এসব প্রতিষ্ঠানে ভুল বানান ও ভাষাদূষণের জন্য মোটাদাগে কয়েকটি কারণকে দায়ী করা যায়। এগুলো হলো:
১। চাকরির নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে বানানের বিশুদ্ধতা রক্ষার ব্যাপারে কোনো শর্ত আরোপ না করা।
২। নিয়োগের সময় সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারীর ভাষাজ্ঞানের পরীক্ষা না নেওয়া।
৩। দায়িত্ব পালনের সময় শুদ্ধ বানানের ওপর প্রাতিষ্ঠানিকভাবেই গুরুত্ব আরোপ না করা।
৪। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে নিজস্ব বানানরীতি প্রণয়নের প্রবণতা।
৫। বানান ভুলের জন্য শাস্তির ব্যবস্থা না থাকা।
কোনো সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানেরই নিয়োগবিজ্ঞপ্তিতে নির্ভুল বানান ও শুদ্ধবাক্য গঠনের ব্যাপারে কোনো শর্ত আরোপ করা হয় না। অথচ শিক্ষাগত যোগ্যতার পাশাপাশি বেশি কয়েকটি যোগ্যতার ব্যাপারে শর্ত দেওয়া হয়। ফলে চাকরির আবেদনপত্রটি শুদ্ধ বানান-শুদ্ধবাক্যে লিখিত হয়েছে কি না, সেটি চাকরিদাতা প্রতিষ্ঠানগুলো খতিয়ে দেখে না। প্রতিষ্ঠানগুলো দেখে কেবল চাকরিপ্রার্থীর শিক্ষাগত যোগ্যতাসহ কয়েকটি মামুলি শর্ত। এছাড়া কখনো কখনো চাকরির পূর্ব অভিজ্ঞতাও দেখে তারা। ফলে ভাষার বিশুদ্ধতা রক্ষার ক্ষেত্রে কোনো চাকরিপ্রার্থীই যত্নশীল হন না। বিশেষত ভাষার লেখ্যরূপের শুদ্ধাচারের বিষয়ে তারা উদাসীন থাকেন।
চাকরিপ্রার্থীদের সঙ্গে কর্তৃপক্ষের সাক্ষাৎকারপর্বেও ভাষার শুদ্ধতা বা শুদ্ধ বানানে লেখা প্রসঙ্গে সাধারণত কোনো কথা হয় না। বরং স্ব-স্ব পদের জন্য তারা কত বেশি শ্রম দিতে প্রস্তুত, সে বিষয়ে প্রশ্নের পর প্রশ্নে চাকরিপ্রার্থীকে জর্জরিত করা হয়। তবে, এ সময়ে সবচেয়ে বেশি নিজেকে প্রাজ্ঞ হিসেবে উপস্থাপনের সুযোগ নেন চাকরিদাতা প্রতিষ্ঠানের কর্তাব্যক্তিরা। পাশাপাশি চাকরিপ্রার্থীর প্রতিষ্ঠানটির জন্য কতটা তার শ্রমক্ষয় করবেন, সে বিষয়েও অঙ্গীকার আদায় করে নেন তারা।
সাক্ষাৎকার-পর্ব শেষে নির্বাচিতদের মধ্যে থেকে যখন নিয়োগপ্রক্রিয়া শুরু হয়, তখনো ভাষার ওপর দক্ষতার বিষয়টি পরীক্ষা করা হয় না। প্রতিষ্ঠানের নতুন কর্মীটি শুদ্ধ বানানে লিখতে পারেন কি না, সেটি কেউ খতিয়ে দেখেন না। এছাড়া, ভাষার কথ্যরূপের শুদ্ধাচারের ব্যাপারে সবাইকে উদাসীন থাকতে দেখা যায়। আর গণমাধ্যম থেকে শুরু করে সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কেউ-ই তাদের দায়িত্ব পালনের সময় ভাষার বিশুদ্ধতারক্ষায় যত্নশীল হন না। যার যেমন খুশি, তিনি সেভাবেই দাপ্তরিক কাজ করছেন। দায়িত্বপালনের সময় দাপ্তরিক প্রয়োজনে লিখিত প্রজ্ঞাপন, নোটিশ, চিঠিপত্রের ভাষা শুদ্ধ কি না, নির্ভুল বানান ও বাক্যে রচিত হচ্ছে কি না, সে বিষয়ে প্রতিষ্ঠান থেকে কোনো দিক-নির্দেশনার কোনো স্বাক্ষর পাওয়া যায় না।
প্রাতিষ্ঠানিকভাবে ভাষার শুদ্ধতারক্ষার ওপর গুরুত্ব আরোপ করলে কর্মকর্তা-কর্মচারীরা ভাষাকে দূষণমুক্ত রাখার চেষ্টা করতেন। কিন্তু প্রাতিষ্ঠানিকভাবে ভাষার বিশুদ্ধতা রক্ষার চেষ্টা না করে, পরন্তু চরম অবহেলার সঙ্গে ভাষা চর্চা করা হচ্ছে।
ভাষার শেখার প্রথম জায়গা হলো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর অধিকাংশ শিক্ষকই নির্ভুল বানানে বাক্যগঠনে মনোযোগী নন। কোমলমতি শিশুদের প্রতিটি বর্ণের নির্ভুল উচ্চারণ শেখানোর ব্যাপারে শিক্ষকরা যত্নশীল হন না। ফলে শৈশব থেকেই শিক্ষার্থী কোনো কোনো বর্ণের ভুল উচ্চারণে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে। এভাবে অভ্যস্ত হয়ে পড়ায় পরিণত বয়সেও তারা আর নির্ভুল উচ্চারণ আয়ত্ত করতে পারে না। ফলে সারাজীবনই ভুল উচ্চারণেই কথা বলে। এছাড়া, লেখ্যরূপের ক্ষেত্রেও একই পরিণতি ঘটে। সর্বনাম-ক্রিয়াপদের সাধুরীতি, চলিতরীতি, ণ-ত্ববিধি কিংবা ষত্ববিধি, উৎপত্তিগত দিক থেকে শব্দের শ্রেণীবিভাগ, সমাজ-কারক-প্রত্যয়ের যথাযথ ব্যবহার সম্পর্কে প্রাথমিক কিংবা মাধ্যমিক স্তরে পড়ানো হলেও ব্যবহারিক জীবনে শিক্ষক-শিক্ষার্থী— কেউই চর্চা করেন না। এর ফলে কিভাবে ভাষায় দূষণ ঘটছে, কিভাবে গুরুচণ্ডালী ভুল হচ্ছে, সে বিষয়ে কেউ সতর্ক থাকছেন না।
ভাষা শেখার সবচেয়ে বড় ক্ষেত্র—সংবাদপত্র। আর সংবাদপত্রের ভাষা ও তথ্যকে নির্ভুল মনে করে সাধারণ শিক্ষিত মানুষ। এ কারণে গণমাধ্যম যে তথ্য দেয়, সাধারণ মানুষ প্রায় বিনা প্রশ্নে সেই তথ্যকে সত্য বলে ধরে নেই। একইসঙ্গে গণমাধ্যমে ব্যবহৃত বিভিন্ন শব্দের বানানকেই বিশুদ্ধ বলে মনে করেন সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে উচ্চশিক্ষিতরাও। আর এই গণমাধ্যমগুলো সংবাদ প্রকাশে যতটা প্রতিযোগিতায় নামে, ভাষার শুদ্ধতারক্ষায় ততটা আন্তরিক হয় না। অথচ গণমাধ্যমের কাজ কেবল সংবাদ প্রকাশ নয়, ভাষাকে দূষণমুক্ত রাখাও এর দায়। পাশাপাশি বড় ভূমিকা রয়েছে জনমত গঠনে। এ কারণে শুদ্ধ বানানে শব্দগঠন ও শুদ্ধভাবে সংলাপ উচ্চারণ ও সংবাদ পাঠে বিশেষভাবে গুরুত্ব দেওয়া উচিত প্রতিটি গণমাধ্যমের। প্রতিবেদন যেমন বস্তুনিষ্ঠ করার চেষ্টা এর থাকতে হয়, তেমনি থাকতে হয় ভাষার বিশুদ্ধতা নিশ্চিতের চেষ্টাও।
বানান ভুলের জন্য বড় দায়ী বাংলা একাডেমি। এই স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানটি প্রমিত বানানরীতির যে নিয়ম তৈরি করেছে, সেখানেই রয়ে গেছে আসল গলদ। একই শব্দের দ্বৈতরীতি যেমন রেখেছে, তেমনি রেখেছে বেশকিছু বানান ও সমাসবদ্ধ শব্দগঠনের ক্ষেত্রে অস্পষ্টতাও। বানান ও শব্দগঠন-সংক্রান্ত এই জটিলতার সুযোগ নিয়ে গণমাধ্যম ছাড়াও বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান বানান বিষয়ে স্বৈরাচারী আচরণ করে আসছে। যেমন, ইদ ও ঈদ, কোনো ও কোনও, কখনো ও কখনও। বাংলা একাডেমির অভিধানে এসব শব্দের দুটি বানানই রেখে দেওয়া হয়েছে। এছাড়া, বানানরীতি অনুযায়ী অতৎসম ও বিদেশি সব শব্দে হ্রস্ব ই-কার (ি) ব্যবহৃত হবে। কিন্তু ‘বাংলা একাডেমি আধুনিক বাংলা অভিধান’-এ কি-বোর্ড (Key board)-কে লেখা হয়েছে ‘কী-বোর্ড’। অথচ বানানরীতিতে বলা হয়েছে, সব ধরনের বিদেশি শব্দে হ্রস্ব ই-কার ব্যবহৃত হবে। তাহলে কোন যুক্তি ‘কি-বোর্ড’কে ‘কী-বোর্ড’ লেখা হলো, এর কোনো ব্যাখ্যা অভিধানে দেওয়া হয়নি।
এছাড়া ‘বাংলা একাডেমি প্রমিত বাংলা বানানের নিয়ম’-এ বলা হয়েছে, গুণী, প্রাণী, মন্ত্রী শব্দ সমাসবদ্ধ করার ক্ষেত্রে ‘গুণিজন’, ‘প্রাণিবিদ্যা’, ‘মন্ত্রিপরিষদ’ লিখতে হবে। তবে, ‘গুণীজন’, প্রাণীবিদ্যা’ ও ‘মন্ত্রীপরিষদ’ও লেখা যাবে। ইংরেজি কবু শব্দের বাংলা ‘কি’ এবং দ্বৈতরীতির ক্ষেত্রে যেকোনো একটি বানান গ্রহণ করে অন্যটি বাতিল করে দেওয়া উচিত ছিল। তাহলে সাধারণ মানুষ বানানবিষয়ক বিভ্রান্তি থেকে অনেকটাই মুক্তি পেতো। দুটি বানানই রেখে দেওয়ায় ও ইংরেজি শব্দে দীর্ঘ ঈ-কার (ী) রাখায় জটিলতা তৈরি হয়েছে। দ্বৈতরীতির বানান ও দ্বৈতরীতির সমাসবদ্ধ শব্দের ক্ষেত্রে গণমাধ্যম থেকে শুরু করে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানেও এ দুটি রীতিরই প্রয়োগ করা হচ্ছে। আর কোনো কোনো প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তিপর্যায়েও ইংরেজি শব্দের বাংলা প্রতিবর্ণীকরণে হ্রস্ব ই-কার ও দীর্ঘ ঈ-কারের দুটিই ব্যবহৃত হচ্ছে। এরফলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে শিক্ষার্থীরা। বানান নিয়ে এমন বিশৃঙ্খলার কারণে ব্যবহারকারীদের একপক্ষ আরেক পক্ষকে মূর্খ মনে করছে।
দ্বৈতরীতির বানানের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি বিশৃঙ্খলা ঘটছে, ‘কোনো’>‘কোনও’, ‘এখনো’>‘এখনও’, ‘তখনো’>‘তখনও’, ‘কখনো’>‘কখনও’, ‘আজো’>‘আজও’; ‘আরও’>‘আরো’, ‘আবারও’>‘আবারো’, ‘এবারও’>‘এবারো’, ‘দপ্তর’>‘দফতর’ শব্দের ক্ষেত্রে বেশি। যারা প্রথম রীতিতে লিখছেন, তারা দ্বিতীয় রীতিকে ভুল বলছেন। আবার দ্বিতীয় রীতি যারা লিখছেন, তারা প্রথম রীতিকে ভুল বলছেন। অথচ বাংলা একাডেমি একটি সুনির্দিষ্ট নীতিমালা করে একটি রীতিকে গ্রহণ করে অন্যটিকে রদ করতে পারতো। এক্ষেত্রে যেকোনো একটি বোঝাতে ‘কোনো’ এবং যেকোনো সময় বোঝাতে ‘এখনো’, ‘কখনো’, ‘তখনো’, ‘আজো’ বানান রেখে বিকল্প রীতিকে বাতিল করে দিতে পারতো। এছাড়া, অধিকন্তু ও ফের বোঝাতে ‘আরও’, ‘আবারও’ ও ‘এবারও’ বানান রেখে বিকল্প বানানকে বাদ দেওয়া উচিত ছিল। অভিধানেও একটি রীতি রেখে বিকল্প রীতিকে বাতিল করা উচিত ছিল। তাহলে শিক্ষার্থী থেকে শুরু করে শিক্ষক, সাহিত্যিক, সাংবাদিক— কাউকেই বানান নিয়ে অকারণে বিভ্রান্ত হতে হতো না।
তবে, উল্লিখিত কারণগুলো ছাড়া আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ রয়েছে। সেটি হলো, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে নিজস্ব বানানরীতি প্রণয়নের প্রবণতা। এক্ষেত্রে বিশেষত গণমাধ্যমগুলো নিজ-নিজ মর্জি মতো বানানরীতি প্রণয়ন করে। এই প্রবণতা এসব প্রতিষ্ঠানকে হয়তো স্বাতন্ত্র্য মর্যাদা দেয়, কিন্তু ভাষার জন্য বয়ে আনে চরম বিপর্যয়-বিশৃঙ্খলা। গণমাধ্যমগুলো নিজস্ব ভাষাশৈলী, সংবাদসংক্রান্ত নীতিমালা তৈরি করতে পারে। কিন্তু বানান নিয়ে নিজস্ব রীতি চালু করার আগে ভেবে দেখা উচিত— এই রীতি উপকারের কাজে অপকার বেশি করবে কি না। এছাড়া একেক প্রতিষ্ঠানের একেক বানানরীতি দেখে পাঠক স্বভাবতই বিভ্রান্ত হতে পারে। বিষয়টি গণমাধ্যমগুলোর কর্তব্যক্তিদের ভেবে দেখা উচিত। একথা ভুলে গেলে চলবে না, একটি ভাষার একই শব্দের অভিন্ন বানানরীতি ব্যবহার না করে একাধিক নিয়ম চালু হলে বিশৃঙ্খলা বাড়বে। এতে ভাষাদূষণ যেমন ঘটবে, তেমনি সৃষ্টি হবে ব্যক্তি পর্যায়ে আত্মম্ভরিতার প্রবণতাও। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের উচ্চ পদে আসীনরা স্ব-স্ব বানানরীতি চালু করে দিতে পারেন। একইসঙ্গে নিজের চালু করা বানানরীতির পক্ষে তুলে ধরতে পারেন যুক্তিও।
কিন্তু বাংলা বানান নিয়ে কেন এই বিশৃঙ্খলা? কেন ভাষাকে দূষণমুক্ত করা হচ্ছে না? সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে ভাষাদূষণকে অপরাধ হিসেবে দেখা হচ্ছে না। এজন্য এমন কর্মকাণ্ডের দায়ে কোনো শাস্তিরও ব্যবস্থা নেই। কোনো কর্মকর্তা বা অফিস সহকারীর বানান ভুলের জন্য বেতন কেটে নেওয়া, চাকরিচ্যুতি, কারাদণ্ড বা অর্থদণ্ডের মতো শাস্তির ব্যবস্থা নেই। এ কারণেই বানান শুদ্ধ করার ব্যাপারে কারও কোনো আগ্রহ কিংবা সততা নেই। যদি চুরি-ডাকাতি-গুম-খুনের মতো ভুল বানানে লেখালেখিকে ফৌজদারি অপরাধ হিসেবে গণ্য করে কারাদণ্ড বা অর্থদণ্ড বা উভয়দণ্ডের বিধান থাকতো, তাহলে এ বিষয়ে মানুষ সতর্ক-সচেতন হতো। এছাড়া, বাংলা একাডেমিও যে অভিধানে বানান নিয়ে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে রেখেছে, সেজন্য তদন্ত সাপেক্ষে দায়ী ব্যক্তিকে শাস্তির আওতায় আনা গেলে বানান ভুলের পরিমাণ কমে আসতো। কমতো ভাষাদূষণের প্রবণতাও।
লেখক: কবি-প্রাবন্ধিক ও সাংবাদিক