লবণ নিয়ে লঙ্কাকাণ্ড!
‘হুজুগে বাঙালি’ বলে একটা প্রবচন বহুকাল থেকেই চালু আছে। ‘পরশ্রীকাতর’ বা ‘সুযোগ-সন্ধানী’ অভিধাগুলোও পুরনো। বলা যায় এসব বিষয়ে আমাদের একটা স্বতন্ত্র জাতিগত বৈশিষ্ট্য গড়ে উঠেছে। এসবের সাথে নতুন আপদ হয়ে দেখা দিয়েছে ‘গুজব ছড়ানো’ ও ‘ঝোপ বুঝে কোপ মারার’ ভয়ঙ্কর প্রবণতা। সম্প্রতি নানা ঘটনাপ্রবাহে বিষয়গুলো যেমন দৃশ্যমান হচ্ছে, তেমনি সঙ্কটের আবর্তে ঘুরপাক খাচ্ছে জনজীবন।
১
ঊচ্চমূল্যের বিশ্বরেকর্ড গড়ার পর সরকারের নানামুখী উদ্যোগে পেঁয়াজ-বাজারের অস্থিরতা থিতিয়ে আসার পথে। তবে তার আগেই লবণ নিয়ে শুরু হয়ে গেছে সঙ্কটের নতুন পর্ব। পেঁয়াজের মূল্যবৃদ্ধির নেপথ্যে বাজার-বাস্তবতা থাকলেও লবণের বিষয়টি পুরোপুরি গুজব। শিল্প মন্ত্রণালয় বলছে, দেশে প্রতি মাসে ভোজ্য লবণের চাহিদা কমবেশি এক লাখ মেট্রিক টন। সেখানে লবণের মজুত আছে সাড়ে ৬ লাখ মেট্রিক টন। সে হিসাবে লবণের কোনো ধরনের ঘাটতি বা সঙ্কটের প্রশ্নই ওঠে না। কিন্তু কে শোনে কার কথা। ‘লবণের কেজি ২০০ টাকা হবে’ এই গুজবে কান দিয়ে বিভিন্ন স্থানে মুদি দোকানে দীর্ঘ সারিতে দাঁড়িয়ে পড়েছেন গ্রাহকরা। সামর্থ অনুযায়ী বেশি করে লবণ কিনে তারা আসন্ন সঙ্কট মোকাবিলার নিদান খুঁজছেন। কারণ পেঁয়াজের ঝাঁঝে এমনিতেই তাদের চোখ ঝাপসা। লবণ নিয়ে নতুন বিপদে তারা পড়তে চাইছেন না। অথচ সরকারের পাশাপাশি ডিলাররাও বলছেন দেশে লবণের কোনো সঙ্কট নেই।
ভোক্তাদের এ শঙ্কাকে পুঁজি করে তৎপর হয়ে উঠেছে সুযোগ-সন্ধানী মজুতদাররাও। সুযোগ তো সব সময় আসে না। কাজেই ‘বাণিজ্যে বসতি লক্ষ্মী’- এ মন্ত্রে উজ্জীবিত হয়ে সুযোগ কাজে লাগিয়ে কৃত্রিম সঙ্কট সৃষ্টির মাধ্যমে যদি টুপাইস কামিয়ে নেয়া যায়! শুরু হয়ে গেছে ঠেলাগাড়িতে ভরে গুদামে লবণ মজুতের প্রতিযোগিতা। ফলে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে লবণের দাম বৃদ্ধি সংক্রান্ত খবর আসছে। খোদ রাজধানীতে ৪৫ টাকার লবণ ১২০ টাকায় লুফে নিচ্ছেন ক্রেতারা। যদিও প্রশাসন গুজব অপপ্রচার প্রতিরোধে মাঠে নেমেছে। চলছে মুনালোভী ব্যবসায়ীদের জেল-জরিমানা ও লবণ জব্দের অভিযান।
২
এবার একটু পেঁয়াজ প্রসঙ্গে ফেরা যাক। পত্র-পত্রিকার খবর অনুযায়ী চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জে একদিনে কেজিতে পেঁয়াজের দাম কমেছে ১০০ টাকা। দেশের প্রধান পাইকারি বাজারটিতে ১১০ থেকে ১৩০ টাকা কেজিতে বিক্রি হচ্ছে। বিভিন্ন জেলায়ও কমতে শুরু করেছে পেঁয়াজের দাম। মিসর থেকে কার্গো বিমানে আমদানি করা পেঁয়াজের প্রথম চালান আজ মঙ্গলবার দেশে পৌঁছুলে দাম আরো কমবে বলে আশা করছেন বাজার সংশ্লিষ্টরা।
পেঁয়াজ চাষে এখনো আমরা স্বয়ংসম্পূর্ণ নই। চাহিদা মেটাতে তাই নির্ভর করতে হয় আমদানির ওপর। যার সিংহভাগ ভারত থেকেই আসে। কিন্তু দেশটি রপ্তানি বন্ধের ঘোষণা দিলে গত মাস (অক্টোবর) থেকে বাড়তে থাকে পেঁয়াজের দাম। পেঁয়াজের এ ঊর্ধগতির রাশ টেনে ধরতে সরকার নানা পদক্ষেপ নিলেও চলমান বাজার-বাস্তবতায় সব উদ্যোগই ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। ফলে দেশের অনেক জায়গায় পেঁয়াজের কেজি গিয়ে ঠেকে ৩০০ টাকায়! সার্বিক পরিস্থিতি সামাল দিতে সরকার যে ব্যর্থ হয়েছে সে তা অস্বীকার করা জো নেই।
এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন, প্রতিবছরই এসময় পেঁয়াজের দরে কিছুটা উল্লম্ফন ঘটে। মৌসুমের নতুন পেঁয়াজ বাজারে এলে যথারীতি দামও চলে আসে নাগালের মধ্যে। তবে নিকট অতীতে বাঙালির রসুইঘরের অপরিহার্য এ উপাদানটির এমন অস্বাভাকি দাম আর দেখা যায়নি। পেঁয়াজের এই অস্বাভাকি ঊচ্চমূল্যের নেপথ্যে কৃত্রিম সঙ্কট সৃষ্টিকারী মজুতদার-বেনিয়াদেরও হাত আছে। বিভিন্ন স্থানে শত শত মণ পঁচা পেঁয়াজ ভাগাড়ে ফেলার ছবি সে কথাই প্রমাণ করে। দাম ‘আরো বাড়বে’ হুজুগে বাঙালির এই অতি উৎসাহ তাদের এই ফেরেববাজির বড় হাতিয়ার। লবণ নিয়েও শুরু হয়েছে নতুন সঙ্কট তৈরির পাঁয়তারা।
বস্তুত, কোনো বিষয় খতিয়ে না দেখে, পূর্বাপর না ভেবে গুজবে কান দেয়ার প্রবণতার কারণে বার বার দেশে অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটছে। তৈরি হচ্ছে নানা সঙ্কট। গুজবের ডালপালায় ভর করে এদেশে চিরকাল একটি শ্রেণি রাতারাতি আখের গুছিয়ে নিয়েছে। গুজব রোধে সরকারের নানা উদ্যোগও ভেস্তে যাচ্ছে কছিু সুবিধাভোগীর কারণে। যার খেসারত দিতে হয় সাধারণ মানুষকেই। ফলে যার যার অবস্থান থেকে সতর্ক হওয়া ছাড়া কোনো গত্যন্তর নেই।