এবার দেশের ৬০ স্থানে পালিত হচ্ছে উপকূল দিবস
খোলাডেক্স :
উপকূলবাসীর জীবনমান উন্নয়নসহ উপকূল সুরক্ষার লক্ষ্য সামনে রেখে এবার দেশে এবার তৃতীয় বারের মত ‘উপকূল দিবস’ পালিত হচ্ছে। ১৯৭০ সালের ১২ নভেম্বরের প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড়ের দিনটিকে ‘উপকূল দিবস’ হিসাবে প্রস্তাব করা হয়েছে। এদিন উপকূলের ৬০ স্থানে একযোগে ‘উপকূল দিবস’ পালিত হবে। কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে র্যালী, আলোচনা সভা, ঘূর্ণিঝড়ে প্রয়াতদের স্মরণে মোমবাতি প্রজ্জলন এবং স্মারকলিপি পেশ।
উপকূল দিবস উপলক্ষে ১২ নভেম্বর সকাল সাড়ে ১১টায় ঢাকায় জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে মানবন্ধন অনুষ্ঠিত হবে। একই সময়ে উপকূলের ৬০ স্থানে মানবন্ধন, র্যালী ও আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হবে।
দিবসটি উপলক্ষে ৯ নভেম্বর ২০১৯, শনিবার বিকেলে জাতীয় প্রেসক্লাবের তোফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া হলে ‘১২ নভেম্বরকে ‘উপকূল দিবস’ হিসাবে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতির দাবিতে’ গোলটেবিল আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়। ’কোষ্টাল জর্নালিজম নেটওয়ার্ক’ এর উদ্যোগে এ অনুষ্ঠানে সার্বিক সহযোগিতা দেয় ’চেঞ্জ ইনিশিয়েটিভ’।
বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ডরপ-এর প্রতিষ্ঠাতা এ এইচ নোমানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সাংবাদিক রফিকুল ইসলাম মন্টু। বক্তব্য রাখেন লক্ষ্মীপুর-৪ আসনের সংসদ সদস্য মেজর (অব:) আবদুল মান্নান, পটুয়াখালী-৩ আসনের শাহজাদা সাজু, সংবিধান বিশেষজ্ঞ ইকতেদার আহমেদ, পটুয়াখালী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি আবদুল লতিফ মাসুম, জল ও পরিবেশ ইনস্টিটিউটের চেয়ারম্যান ইনামুল হক, দুর্যোগ বিশ্লেষক গওহার নঈম ওয়ারা এবং আরও অনেকে।
উপকূল দিবস বাস্তবায়ন কমিটি, কোস্টাল জার্নালিজম নেটওয়ার্ক-সিজেএনবি, চেঞ্জ ইনিশিয়েটিভ, উপকূল বাংলাদেশ ফাউন্ডেশন, কোস্টাল ইয়ূথ নেটওয়ার্ক-আলোকযাত্রাসহ বিভিন্ন সংগঠন যৌথভাবে এসব কর্মসূচি পালন করছে।
কর্মসূচি উপলক্ষে ১১ নভেম্বর সন্ধ্যায় পটুয়াখালীর গলাচিপায় ১০০১টি মোমবাতি প্রজ্জনের মাধ্যমে কর্মসূচি পালিত হবে। একই কর্মসূচি নেওয়া হয়েছে বরগুনার তালতলীর শুভসন্ধ্যা সমুদ্র সৈকত এবং লক্ষ্মীপুরের কমলনগরে। দিবসটি স্মরণে সাতক্ষীরার শ্যামনগরের হরিনগরে ফটো প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়েছে। অন্যান্য স্থানে শোভাযাত্রা, আলোচনা সভা ও উপকূল দিবসের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতির দাবিতে স্থানীয় প্রশাসনের কাছে স্মারকলিপি দেওয়া হবে।
রাজধানী ঢাকাসহ উপকূলবর্তী ১৬ জেলার ৫৫ স্থানে দিবসটি পালিত হবে। স্থানগুলো হচ্ছে: কক্সবাজারের কক্সবাজার সদর, টেকনাফ, মহেশখালী; চট্টগ্রামের বাঁশখালী, মিরসরাই, সন্দ্বীপ; ফেনীর ফেনী সদর, সোনাগাজী, ছাগলনাইয়া; নোয়াখালীর সুবর্ণচর, হাতিয়া; লক্ষ্মীপুরের কমলনগর, রামগতি; চাঁদপুরের চাঁদপুর সদর; ভোলার ভোলা সদর, যুগিরঘোল, চরফ্যাসন, তজুমদ্দিন, মনপুরা, লালমোহন, দক্ষিণ আইচা; বরিশালের বরিশাল সদর; পটুয়াখালীর পটুয়াখালী সদর, কলাপাড়া, গলাচিপা, বাউফল, দশমিনা , রাঙ্গাবালী, পাখিমারা, কুয়াকাটা, চরকাজল; বরগুনার বরগুনা সদর, পরীরখাল, বেতাগী, তালতলী, পাথরঘাটা, বামনা, শুভসন্ধ্যা সমুদ্র সৈকত; পিরোজপুরের কাউখালী, ইন্দুরকানী; ঝালকাঠির ঝালকাঠি সদর, কাঁঠালিয়া, নলছিটি; বাগেরহাটের বাগেরহাট সদর, শরণখোলা; খুলনার পাইকগাছা; সাতক্ষীরার সাতক্ষীরা সদর, তালা, শ্যামনগর, বুড়িগোয়ালিনী, হরিনগর।
উপকূল দিবস বাস্তবায়ন কমিটির আহবানে স্থানীয় ও জাতীয় পর্যায়ের শতাধিক সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন ও প্রতিষ্ঠান দিবস পালনে এগিয়ে এসেছে। এরমধ্যে রয়েছে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা, গণমাধ্যকর্মীদের সংগঠন, স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন, গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠান, কিশোর-তরুণদের ফোরাম ইত্যাদি।
এত দিবসের ভিড়ে উপকূলের জন্য একটি পৃথক দিবস প্রসঙ্গে উপকূল দিবস বাস্তবায়ন কমিটির প্রধান সমন্বয়কারী ও উপকূল-সন্ধানী সাংবাদিক রফিকুল ইসলাম মন্টু বলেন, উপকূলের দিকে গণমাধ্যম ও নীতিনির্ধারকদের নজর বাড়িয়ে উপকূলবাসীর জীবনমান উন্নয়ন ঘটানোই উপকূলের জন্য একটি দিবস প্রস্তাবের মূল লক্ষ্য। এক যুগেরও বেশি ধরে উপকূল নিয়ে নিবিড়ভাবে রিপোর্টিং করতে গিয়ে আমি উপকূল দিবসের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করি। উপকূলের জন্য একটি পৃথক দিবস থাকলে উপকূল ভাবনা সবার মাঝে দ্রুত ছড়িয়ে পড়বে। সরকারের নীতিনির্ধারণী মহল, সংবাদ মাধ্যম থেকে শুরু করে সকল মহলে উপকূল-ভাবনার সুযোগ বাড়বে। এর মধ্যদিয়ে উপকূল সুরক্ষা এবং সেখানকার নাগরিকেদের অধিকার নিশ্চিত করার পথ সুগম হবে।
১২ নভেম্বর ‘উপকূল দিবস’ প্রস্তাবের যৌক্তিকতা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, উপকূলবাসীর কাছে স্মরণীয় দিন হিসাবে ১৯৭০ সালের ১২ নভেম্বরকেই ‘উপকূল দিবস’ হিসাবে বেছে নেওয়া হয়েছে। এদিন বাংলাদেশের উপকূলের উপর দিয়ে বয়ে যায় সবচেয়ে শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড় ‘ভোলা সাইক্লোন’। এই ঘূর্ণিঝড় লন্ডভন্ড করে দেয় উপকূল। বহু মানুষ প্রাণ হারান। ঘরবাড়ি হারিয়ে পথে বসেন। এই ঘূর্ণিঝড় গোটা বিশ্বকে কাঁপিয়ে দিয়েছিল। এটি সিম্পসন স্কেলে ক্যাটাগরি ৩ মাত্রার ঘূর্ণিঝড় ছিল। ঘূর্ণিঝড়টি ৮ই নভেম্বর বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট হয়। ক্রমশ শক্তিশালী হতে হতে এটি উত্তর দিকে অগ্রসর হতে থাকে। ১১ নভেম্বর এটির সর্বোচ্চ গতিবেগ ঘন্টায় ১৮৫ কিলোমিটারে পৌঁছায়। ওই রাতেই উপকূলে আঘাত হানে। জলোচ্ছ্বাসের কারণে উপকূলীয় অঞ্চল ও দ্বীপসমূহ প্লাবিত হয়। ওই ঘূর্ণিঝড়ে দশ লাখের বেশি লোকের প্রাণহানি ঘটেছে বলে বিভিন্ন সূত্রের দাবি।
জাতিসংঘের বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থা (ডব্লিউএমও) বিশ্বের পাঁচ ধরনের ভয়াবহ প্রাণঘাতি আবহাওয়া ঘটনার শীর্ষ তালিকা প্রকাশ করে ২০১৭ সালের ১৮ মে। ওই তালিকায় বাংলাদেশের উপকূল অঞ্চলের ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া ১৯৭০ সালের ১২ নভেম্বরের ঘূর্ণিঝড়টিকে পৃথিবীর সর্বকালের ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়ংকর প্রাণঘাতি ঝড় হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।
’৭০-এর ১২ নভেম্বরের প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড় স্মরণে এই দিনটিকে ‘উপকূল দিবস’ হিসাবে ঘোষণার দাবি ওঠে ২০১৭ সালে। সে বছর থেকেই দেশের সমগ্র উপকূল অঞ্চল জুড়ে উপকূল দিবস পালিত হয়ে আসছে। প্রথমবারের মত উপকূল দিবস পালনে গোটা উপকূল জুড়ে সাধারণ মানুষের মাঝে ব্যাপক সাড়া পড়ে। তারা উপকূলের জন্য একটি দিবসের দাবি তোলেন এবং ১২ নভেম্বরকে ‘উপকূল দিবস’ হিসাবে ঘোষণার জন্য সরকারের কাছে দাবি জানান। প্রথম বছরের বিপুল সাড়া পাওয়ার ধারাবাহিকতায় এবছর তৃতীয় বছর আরও বৃহৎ পরিসরে উপকূল দিবস পালনের উদ্যোগ নেওয়া হলো।
প্রসঙ্গত, পূর্বে কক্সবাজারের টেকনাফের শাহপরীর এবং পশ্চিমে সাতক্ষীরার শ্যামনগরের কালিঞ্চি গ্রাম পর্যন্ত সমুদ্ররেখা বরাবর উপকূলের প্রায় ৫ কোটি মানুষ প্রতিনিয়ত বহুমূখী দুর্যোগের সঙ্গে বসবাস করেন। কেবল দুর্যোগ এলেই সংবাদ মাধ্যমে এদের খবরাখবর দেখা যায়। কিন্তু স্বাভাবিক সময়েও তাদের জীবন যে কতটা অস্বাভাবিক, সে বিষয়ে খুব একটা খোঁজ রাখা হয়না। উপকূল দিবসের দাবি বাস্তবায়িত হলে প্রাকৃতিক দুর্যোগ না হলেও উপকূলের বিশেষ খবরের দিকে সংবাদ মাধ্যমের নজর পড়বে।