রিপোর্টার থেকে সম্পাদক
শাহজাহান সরদার
[দেশের জনপ্রিয় দুটি পত্রিকার (যুগান্তর, বাংলাদেশ প্রতিদিন) জন্মের পেছনের ইতিহাস, কর্তৃপক্ষের চাপিয়ে দেয়া বিব্রতকর বিভিন্ন আদেশ নির্দেশ, হস্তক্ষেপ, পত্রিকা প্রকাশের ওয়াদা দিয়ে অন্য একটি জনপ্রিয় পত্রিকা থেকে নিয়ে এসে পত্রিকা না বের করে হাতজোড়ে ক্ষমা প্রার্থনা করে বিদায় দেয়া, পত্রিকা প্রকাশের পর কোন কোন কর্তৃপক্ষ কর্তৃক কিছু দিনের মধ্যেই ছাপা সংখ্যা কমিয়ে দিয়ে লাভ খোঁজা, ইচ্ছেমত সাংবাদিক-কর্মচারি ছাঁটাই করা সহ পত্রিকার অন্দর মহলের খবরা-খবর, রাজনৈতিক মোড় ঘুড়িয়ে দেয়া কিছু রিপোর্ট, সাংবাদিক ইউনিয়ন, ঢাকা রিপোটার্স ইউনিটির কিছু ঘটনা এবং মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ নিয়ে আমার এ বই ‘রিপোর্টার থেকে সম্পাদক’। জানতে পারবেন সংবাদপত্র জগতের অনেক অজানা ঘটনা, নেপথ্যের খবর।]
পূর্বকথন
কয়েক বছর ধরেই ভাবছিলাম সংবাদপত্র ও সাংবাদিকতা সম্পর্কে আমার অভিজ্ঞতা ও কার্যক্রম নিয়ে একটি বই লিখব। কিন্তু লেখা আর হয়ে ওঠে না। ভাবি এ বিষয়ে আমার লেখার যোগ্যতাটাই কতটুকু। আবার হিসাব করে দেখি সাংবাদিকতার বয়স চার দশকেরও বেশি। এ সময়ে রিপোর্টার থেকে শুরু করে চিফ রিপোর্টার, উপ-সম্পাদক এবং সর্বশেষ সম্পাদক হিসেবে কাজ করেছি এবং করছি।
একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা থেকে কাজ শুরু করে সর্বাধিক প্রচারিত দৈনিক সংবাদপত্রের প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক হিসাবেও কাজ করেছি। এছাড়া আরও কয়েকটি সংবাদপত্রের সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছি। এক সময়ের দেশের সর্বাধিক প্রচারিত দৈনিক যুগান্তর কেন, কিভাবে প্রকাশ হলো এর সম্পূর্ণটাই আমার জানা। আর নেপথ্যে আমার ভুমিকার কথা সিনিয়র সাংবাদিকদের কেউ কেউ জানেন। আর বর্তমান কালের ১২ পৃষ্ঠার সর্বাধিক প্রচারিত বাংলাদেশ প্রতিদিনের শুরু আমার হাত দিয়েই। আমি সম্পাদক থাকাকালেই পত্রিকাটি প্রচার সংখ্যায় শীর্ষে পৌঁছে। সেই সময়কার প্রচার সংখ্যার শীর্ষের পত্রিকার সম্পাদক পদ স্বেচ্ছায় ছেড়েছি। মালিক কর্তৃপক্ষকে আমার পদত্যাগের কথা জানানোর পর তারা তা সহজে নিতে পারেননি। আমাকে দফায় দফায় চিন্তা করার সময় দিয়েছিলেন। সময় নিয়ে চিন্তা করেও আর্কষণীয় সম্পাদকের পদ ছেড়ে আসি। আমার এই পদত্যাগ কেন, এ নিয়ে আমার স্ত্রী, সন্তান, সহকর্মী, শুভানুধ্যায়ীসহ অনেকেরই প্রশ্ন। বাংলাদেশ প্রতিদিন ছেড়ে সেদিনই আরেকটি সংবাদপত্রের সম্পাদক পদে যোগদান করেছিলাম। কিন্তু সেই সংবাদপত্র আর আলোর মুখ দেখেনি। কিন্তু অনেক স্বপ্ন দেখিয়ে আমাকে বাংলাদেশ প্রতিদিন থেকে এনে সেই মালিক সংবাদপত্র বের না করে হাতজোড় করে ক্ষমা প্রার্থনা করে বিদায় দেন। এরপর বাধ্য হয়ে যোগ দিই দৈনিক মানবকণ্ঠ পত্রিকায়। এই পত্রিকাটি তখন প্রকাশের অপেক্ষায় ছিল। আমি যোগ দেয়ার পরই পত্রিকাটি বাজারজাত শুরু হয়। বাজারও পায় ভাল। কিছুদিনের মধ্যেই মালিক পক্ষ আর্থিক সংকটের কারণে প্রচার সংখ্যা কমিয়ে দেয়। সাংবাদিক-কর্মচারীদের বেতনভাতা বাকি পড়তে থাকে। এ অবস্থায় আমি মালিকদের বলে কয়ে সেখান থেকে বিদায় নিয়ে যোগদান করি দৈনিক আলোকিত বাংলাদেশ পত্রিকায়। ঢাকা আহছানিয়া মিশনের পত্রিকা এটি। অনেক স্বপ্নের কথা বলে তারা আমাকে নিয়ে যান। কিন্তু যোগদানের প্রথম দিন থেকেই এ পত্রিকা কর্তৃপক্ষের কথায় ও কাজে অমিল লক্ষ্য করি। তাই স্বেচ্ছায় আবার চাকরি ছাড়ি। এরপর দীর্ঘ বেকারত্ব। এরই মধ্যে নিজে একটি দৈনিক সংবাদপত্রের ডিক্লারেশন নিয়েছিলাম। অর্থের অভাবে নিয়মিত প্রকাশ করা সম্ভব হয়ে ওঠে না। তবে এখন আবার আরেকটি সংবাদপত্রে সম্পাদক হিসাবে যোগ দিয়েছি। নাম বাংলাদেশ জার্নাল। অনলাইন চালু হয়েছে আর কাগজটি প্রকাশের প্রক্রিয়া চলছে।
এতক্ষণ শুধু পত্রিকা নিয়ে বললাম। এছাড়াও কথা আছে। রিপোর্টার হিসাবে আমি বহুদিন কাজ করেছি। এক সময় দেশের সর্বাধিক প্রচারিত দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকার সিনিয়র রিপোর্টার, চিফ রিপোর্টারও ছিলাম। রিপোর্টার থাকাকালে দেশের রাজনৈতিক উত্থান পতনের অনেক কিছু কাছ থেকে দেখার সুযোগ হয়েছে। সাংবাদিকতা জীবনে উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিদের নেয়া অনেক সাক্ষাতকার এবং আমার অনেক রিপোর্ট বিভিন্ন সংবাদপত্রে ছাপা হয়েছে। যেগুলো ছিল চাঞ্চল্যকর। বেশ কয়েকটি রিপোর্ট ও সাক্ষাতকার জাতীয় রাজনীতির মোড়ও ঘুরিয়ে দেয়। আবার রিপোর্টার হিসাবে দেশ-বিদেশে অফিস অ্যাসাইনমেন্টে যেমন গিয়েছি, ব্যক্তিগতভাবেও অনেক দেশ সফর করেছি। এসব সফরেরও অনেক অভিজ্ঞতা আছে।
সব বিষয় চিন্তা করেই ভাবলাম, দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা ও সংবাদিকতা জীবনের নানা ঘটনা নিয়ে ছোট খাট একটি বই হয়তো লেখাই যায়। তাই কয়েক বছরের দোদুল্যমানতা শেষে লেখা শুরু করি। আমি ব্যক্তিগতভাবে কোন ডাইরি লিখিনা, নোট করেও রাখিনা। তাই সব কিছুই স্মৃতি থেকে লেখা। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় তার ‘অর্ধেক জীবন’ গ্রন্থে লিখেছেন ‘আমি আমার বিস্তর কবিতায় ও গল্প উপন্যাসে নিজের জীবনকে ব্যবহার করেছি টুকরো টুকরোভাবে। এখানে শুধু একটু একটু করে ছুঁয়ে গেছি মাত্র।’ আমিও বলতে চাই, সাংবাদিকতা জীবনের পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস লেখার ধারে কাছে না গিয়ে বিশেষ কিছু ঘটনার উল্লেখ করেছি মাত্র। যা ছুঁয়ে যাওয়ার মতোই। কিন্তু সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের মত আমি ‘অর্ধেক জীবন’ বলতে রাজি নই। তবে একথা বলতে হবে, বইটি আমার ব্যক্তি জীবন থেকে শুরু করে সাংবাদিকতা জীবনের এক অসমাপ্ত দলিল মাত্র। এতে সাংবাদিকতাসহ ব্যক্তি জীবনের টুকরো টুকরো কিছু কাহিনী সংযোজন করা হয়েছে। যেমন কলেজ জীবনে মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় অংশগ্রহণ, সাংবাদিক ইউনিয়ন ও ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে সম্পৃক্ততা ও নেতৃত্ব দান, জাপান সফর নিয়ে লেখা কিছু তথ্যমূলক ঘটনা বইটিতে সংযোজন করা হয়েছে।
সংবাদপত্র এবং সাংবাদিকতা নিয়ে যারা পড়ছেন, পড়বেন এবং গবেষণা করছেন, তাদের জন্য এই বইটি কিছুটা হলেও কাজে আসতে পারে। কেননা বইয়ে দুটি জনপ্রিয় পত্রিকার পূর্ণ জন্ম ইতিহাস রয়েছে। যা অনেকেরই অজানা। এছাড়া কোন কোন পত্রিকার মালিক পক্ষের ধ্যান-ধারণা, বিশেষ সময়ে তাদের আদেশ-নির্দেশ নিয়েও কথা আছে। আমি এ গ্রন্থে এসবের কিছুটা তুলে ধরেছি। দু’একটি ক্ষেত্রে আমার নিজস্ব মন্তব্য রয়েছে। যা ঘটনার সাথে সম্পৃক্ত, কাউকে ছোট বা বড় করার জন্য নয়। সবই সত্য ঘটনা। আর সবচেয়ে বড় কথা হল, এ বইয়ে যাদের নাম ব্যবহার করা হয়েছে তাদের একজন কিংবদন্তী সাংবাদিক এবিএম মূসা ছাড়া সবাই এখনও জীবিত। আমার লেখার কোন বিষয়ে যদি কারো মনপীড়া হয়, আমি দুঃখিত। আর যেহেতু সব তথ্য আমাকে কেন্দ্র করে এবং আমার মত করে দেখা, তাই তথ্যগত ভুলের সম্ভাবনা কম। তবে কেউ অন্যভাবেও ভাবতে পারেন। সেটি তার নিজস্ব অধিকার। আমি কিন্তু লিখেছি আমার দেখা, শোনা, জানা থেকে। তবুও যদি এমন কোন তথ্যগত ভুল সঠিক প্রমাণীত হয়, আগামী সংস্করণে তা সংশোধন করা হবে।
ভূমিকা এখনও শেষ হয়নি। কথা আছে। এই বইয়ের নাম কি হতে পারে। এ নিয়ে বছরব্যাপী চিন্তা-ভাবনা করেছি। যেহেতু সবকিছুই টুকরো স্মৃতি, ইতিহাস ইত্যাদি তাই একরকম হতে পারে। আর আমি নিজে রিপোর্টার হিসাবে পেশা শুরু করি। অনেক সম্পাদকের অধীনেও কাজ করেছি। আবার নিজেও অনেক পত্রিকার সম্পাদক হিসাবে দায়িত্ব পালন করি এবং এখনও করছি। তাই নিজের চিন্তাভাবনা থেকে বইটির নামকরণ করলাম রিপোর্টার থেকে সম্পাদক।
শাহজাহান সরদার