মঙ্গলবার, ৫ নভেম্বর ২০১৯
প্রথম পাতা » » অভিযানের নামে ‘ক্রসফায়ারে মৃত্যুর’ রেকর্ড
অভিযানের নামে ‘ক্রসফায়ারে মৃত্যুর’ রেকর্ড
ব্রিটেন-ভিত্তিক মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের তথ্য মতে, বাংলাদেশে ২০১৮ সালে মাদকবিরোধী অভিযানের নামে ৪৬৬ জনকে হত্যা করা হয়েছে। এদের মধ্যে অনেকেই নিরপরাধ বলে জানা গেছে। তাদের মধ্যে একজন সুলেমান (ছদ্মনাম)।
৩৫ বছর বয়সী এক ব্যক্তি একটি বস্তিতে তার ৮ বছর বয়সী মেয়েকে নিয়ে বসবাস করতেন। প্রতিদিন খাবার জোগাড় করতেই তাকে সংগ্রাম করতে হতো।
অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালকে সুলেমানের পরিবার বলেছে, তথাকথিত বন্দুকযুদ্ধে তাকে হত্যার আগে সুলেমান তার পরিবারের এক সদস্যকে ফোন করে জানিয়েছিলেন, তাকে ছেড়ে দেবার বিনিময়ে পুলিশ ২০ হাজার টাকা ঘুষ দাবি করেছে।
সুলেমানের পরিবারের এক সদস্য জানিয়েছেন, পুলিশের দাবি অনুযায়ী ২০ হাজার টাকা দেয়া হয়েছে। কিন্তু এরপর পুলিশ আরো ৫০ হাজার টাকা দাবি করে, নতুবা ক্রসফায়ারে হত্যার হুমকি দেয়।
সুলেমানের খোঁজে তার আত্মীয়রা থানায় গেলে তাদের জানানো হয় যে, সুলেমানকে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। কিন্তু টেলিফোন পাবার তিন থেকে চারদিন পরে আত্মীয়দের জানানো হয় যে সুলেমান ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হয়েছে।
এই ঘটনার মাধ্যমে মানবাধিকার সংস্থাটি তুলে ধরেছে, বাংলাদেশে মাদকবিরোধী অভিযানের নামে কী ঘটছে।
বিষয়টি নিয়ে বাংলাদেশের র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব) এবং পুলিশ সদর দপ্তরের সাথে যোগাযোগ করা হলেও তাদের কাছ থেকে কোন বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
তবে বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তরফ থেকে সবসময় ‘বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের’ বিষয়টি অস্বীকার করা হয়। তাদের তরফ থেকে দাবি করা হয়, যারা নিহত হয়েছে তারা সবাই অপরাধী এবং ‘বন্দুকযুদ্ধেই’ তারা মারা গেছে।
তথাকথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহত হবার ঘটনাগুলোকে তদন্ত করতে ব্যর্থ হয়েছে সরকার।
২০১৮ সালে বাংলাদেশে যত বিচার বর্হিভূত হত্যাকাণ্ড হয়েছে, সেটি গত কয়েক দশকের মধ্যে সবচেয়ে বেশি। ২০১৭ সালের চেয়ে ২০১৮ সালে বিচার-বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড তিনগুণ বেড়েছে।
‘মাদকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’ নাম দিয়ে যে অভিযান শুরু হয়েছে তাতে প্রতিদিন অন্তত একজন মারা গেছে।
যেখানেই র্যাব এর সম্পৃক্ততা ছিল, সেখানেই আইন বহির্ভূত কাজ হয়েছে বলে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের রিপোর্টে বলা হচ্ছে।
ভিকটিমদের বিচারের আওতায় আনা তো দূরের কথা, তাদের গ্রেপ্তারও দেখানো হয়নি।
অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল-এর দক্ষিণ এশিয় অঞ্চলের ডেপুটি ডিরেক্টর দিনুশিখা দিসানায়েকে বলেন, মাদকবিরোধী অভিযান দরিদ্র এলাকাগুলোতে আতঙ্ক সৃষ্টি করেছে। মানুষজন এই ভেবে আতঙ্কিত যে মাদক নিয়ে সামান্য অভিযোগ উঠলেও তাদের প্রিয়জন আরেকটি বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হবে।
সংস্থাটি বলেছে, এসব হত্যাকাণ্ডের যথাযথ তদন্ত না করে উল্টো ‘বন্দুকযুদ্ধ’ কিংবা ‘ক্রসফায়ারের’ সাফাইয়ের জন্য বানোয়াট প্রমাণ জোগাড় করার চেষ্টা করেছে কর্তৃপক্ষ।
অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের সাথে সাক্ষাতকারে অনেকে বলেছে, পুলিশের ভাষ্যের সাথে মিল রেখে ‘ক্রসফায়ার’ কিংবা ‘বন্দুকযুদ্ধের’ পক্ষে বক্তব্য দেয়ার জন্য তথাকথিত সাক্ষীদের বাধ্য করা হয়েছে। যদিও তারা হত্যাকাণ্ড দেখেননি।
অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালকে একজন বলেন, আমরা কিছু দেখিনি। তারা আমাকে ডেকে ভোর সাড়ে পাঁচটার দিকে একটি জায়গায় নিয়ে যায়। তারপর তারা আমাকে বলে সেখানে যা দেখা যাচ্ছে সেটির সাক্ষী হতে। আমি শুধু একটি মোটরসাইকেল দেখেছি, আর কিছু দেখিনি।
অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশন্যাল পাঁচজন ব্যক্তির সাথে কথা বলেছে, যারা এ ধরণের পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছেন।
তারা জানিয়েছেন, ইচ্ছার বিরুদ্ধে তাদের ডেকে নেয়া হয়েছিল। পুলিশের কথা তারা উপেক্ষা করতে পারেননি। কারণ, সেটি করলে তাদের কঠিন পরিণতি ভোগ করতে হবে বলে আশংকা করছিলেন তারা।
অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল কিছু ঘটনা তদন্ত করে দেখেছে বলে তাদের বিবৃতিতে দাবি করা হচ্ছে।
সেখানে বলা হয়েছে, সংস্থাটি যতগুলো ঘটনা তদন্ত করেছে, তার প্রতিটি ক্ষেত্রে দেখা গেছে মৃতদেহ পাবার আগ পর্যন্ত ভিকটিমরা একদিন থেকে একমাস পর্যন্ত নিখোঁজ ছিল।