যে কারণে কুখ্যাত হিটলার
ফিচার ডেস্ক
হিটলারের নাম শুনেননি এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। হিটলার বিশ্ববাসীর কাছে এক আলোচিত নাম। তার জন্ম ১৮৮৯ সালের ২০ এপ্রিল অস্ট্রিয়া ব্যাভেরিয়ার মাঝামাঝি ব্রনাউ নামে এক আধা গ্রামে। তার বাবার নাম ছিলো অ্যালোইস এবং মায়ের নাম কালারা।
হিটলার বিভিন্ন কারণে আলোচিত ছিলো। তিনি ১৯৪৫ সালে বার্লিনে মারা যান। তার মৃত্যুর দীর্ঘদিন পরেও মানুষ তাকে স্মরণ করে। হিটলারকে মূলত বিশ্ববাসী স্মরণ করে তার নিকৃষ্ট হত্যাকাণ্ডের জন্য।
কথিত আছে ১৯৪১ থেকে ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত সময়ে হিটলার অন্তত ১ কোটি ১০ লাখ মানুষকে হত্যা করেছেন। যাদের মধ্যে হিটলারের নাৎসি জার্মান বাহিনী ও দালালদের হাতে নিহত হয় ৬০ লাখ ইহুদি বাকি ৫০ লাখ অ-ইহুদিকে হত্যা করা হয় গণহত্যার সময়ে। এ হত্যাকাণ্ড চলে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার আগে পর্যন্ত।
নাৎসিদের এই গণহত্যার শিকার যেসব অ-ইহুদি তাদের মধ্যে আছে সাধারণ যাযাবর, রোমানি যাযাবর, পোল্যান্ডবাসী, কমিউনিস্ট, সমকামী, সোভিয়েত যুদ্ধবন্দী এবং মানসিক ও শারীরিক প্রতিবন্ধী কিছু মানুষ।
জার্মানি ও জার্মানির অধিকৃত ভূখণ্ডের ৪২,৫০০ ফ্যাসিলিটির একটি নেটওয়ার্ক ব্যবহার করা হয় গণহত্যার শিকার লোকগুলোকে আটক ও হত্যার কাজে। হলোকাস্টের পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নে সরাসরি জড়িত ছিলো ১০ হাজার থেকে ৫০ হাজার লোক।
হিটলারের মা মারা যাওয়ার পর অর্থের অভাবে স্কুল ছেড়ে দেন তিনি। ভাগ্য অন্বেষণে বেরিয়ে পড়লেন হিটলার। ভিয়েনাতে গিয়ে যোগ দেন দিনমজুরের কাজে। অনেকের মতে, ভিয়েনাতে থাকার সময়েই হিটলারের মনে জেগে ওঠে ইহুদি বিদ্বেষ। তখন জার্মানির অধিকাংশ কলকারখানা, সংবাদপত্রের মালিক ছিল ইহুদিরা। তবে তার মনে কেন ইহুদি বিদ্বেষ সৃষ্টি হয় তা নিয়ে অনেক মতভেদ রয়েছে। দেশের অর্থনীতির অনেকটা অংশই তখন নিয়ন্ত্রণ করতো ইহুদিরা। হিটলার কিছুতেই মানতে পারছিলেন না, জার্মান দেশে বসে ইহুদিরা জার্মানদের উপরে প্রভুত্ব করবে। এডলফ হিটলার আক্ষেপ করে বলেছিলেন- ‘ইহুদীরা বেইমান জাতি, এদের কখনও বিশ্বাস করতে নাই, একদিন বিশ্ববাসী বুঝবে ওদের (ইহুদিদের) সম্পর্কে আমার সিদ্ধান্ত সঠিক ছিল কিনা’।
১৯১২ সালে হিটলার ভিয়েনা ছেড়ে যান মিউনিখে। সেই দুঃখ-কষ্ট আর বেঁচে থাকার সংগ্রামে আরো দুই বছর কেটে যায়। ১৯১৪ সালে শুরু হয় প্রথম বিশ্বযুদ্ধ। হিটলার সৈনিক হিসেবে যুদ্ধে যোগ দেন। এই যুদ্ধে সাহস ও বীরত্বের পরিচয় দিলেও কোনো পদোন্নতি হয়নি হিটলারের। কিন্তু যুদ্ধ শেষে দেশ জুড়ে বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। এর মধ্যে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে বিভিন্ন বিপ্লবী দল, বিভিন্ন রাজনৈতিক দল। এদের ওপর গোয়েন্দাগিরি করার জন্য হিটলারকে নিয়োগ করেন কর্তৃপক্ষ। সেই সময় প্রধান রাজনৈতিক দল ছিলো লেবার পার্টি। তিনি সেই পার্টির সদস্য হলেন।
অল্পদিনেই পাকাপাকিভাবে পার্টিতে নিজের স্থান করে নিতে সক্ষম হয় হিটলার। এক বছরের মধ্যেই তিনি হন পার্টিপ্রধান। দলের নতুন নাম রাখা হয় ন্যাশনাল ওয়ার্কার্স পার্টি।
পরবর্তীকালে এই দলকেই বলা হতো নাৎসি পার্টি। ১৯২০ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি প্রথম নাৎসি দলের সভা ডাকা হয়। এতেই হিটলার প্রকাশ করলেন তার পঁচিশ দফা দাবি। এরপর হিটলার প্রকাশ করলেন স্বস্তিকা চিহ্নযুক্ত দলের পতাকা। ক্রমশই নাৎসি দলের জনপ্রিয়তা বাড়তে থাকে। তিন বছরের মধ্যেই দলের সদস্য হলো প্রায় ৫৬০০০ এবং এটি জার্মান রাজনীতিতে এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করে। হিটলার চেয়েছিলেন মিউনিখে অন্য কোনো রাজনৈতিক দলের অস্তিত্ব যেন না থাকে। এই সময় তার পরিকল্পিত এক রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র ব্যর্থ হলো। পুলিশের হাতে ধরা পড়লেন। তাকে এক বছরের জন্য ল্যান্ডসবার্গের পুরনো দুর্গে বন্দি করে রাখা হলো। জেল থেকে মুক্তি পেয়ে আবার রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র কাজে ঝাঁপিয়ে পড়লেন। তার উগ্র স্পষ্ট মতবাদ, বলিষ্ঠ বক্তব্য জার্মানদের আকৃষ্ট করলো। দলে দলে যুবক তার দলের সদস্য হতে আরম্ভ করে।
সমস্ত দেশে জনপ্রিয় নেতা হয়ে উঠলেন হিটলার। ১৯৩৩ সালের নির্বাচনে বিপুল ভোট পেলেন কিন্তু সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেলেন না। পার্লামেন্টের ৬৪৭টির মধ্যে তার দলের আসন ছিল ২৮৮। বুঝতে পারলেন ক্ষমতা অর্জন করতে গেলে অন্য পথ ধরে অগ্রসর হতে হবে। কোনো দল সংখ্যাগরিষ্ঠ না হওয়ায় হিটলার পার্লামেন্ট ভেঙে দিলেন। এবার ক্ষমতা দখলের জন্য শুরু হলো তার ঘৃণ্য রাজনৈতিক চক্রান্ত। বিরোধীদের অনেকেই খুন হলেন। অনেকে মিথ্যা অভিযোগে জেলে গেলো। বিরোধী দলের মধ্যে নিজের দলের লোক প্রবেশ করিয়ে দলের মধ্যে বিশৃঙ্খলা তৈরি করলেন। অল্পদিনের মধ্যেই বিরোধী পক্ষকে প্রায় নিশ্চিহ্ন করে দিয়ে হিটলার হয়ে উঠলেন শুধু নাৎসি দলের নয়, সমস্ত জার্মানির ভাগ্যবিধাতা।
১৯৩৪ সালে হিটলার রাষ্ট্রপতির পরিবর্তে নিজেকে জার্মানির ফুয়েরার হিসেবে ঘোষণা করেন এবং অল্পদিনের মধ্যে নিজেকে দেশের অবিসংবাদিত নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করলেন। তার এই সাফল্যের মূলে ছিল জনগণকে উদ্দীপিত করার ক্ষমতা।
তিনি দেশের প্রান্তে প্রান্তে ঘুরে ঘুরে জনগণের কাছে বলতেন ভয়াবহ বেকারত্বের কথা, দারিদ্র্যের কথা, নানা অভাব-অভিযোগের কথা। হিটলার তার সমস্ত ক্ষমতা নিয়োগ করলেন দেশের সামরিক শক্তি বৃদ্ধিতে। তার সহযোগী হলেন কয়েকজন সুদক্ষ সেনানায়ক এবং প্রচারবিদ। দেশের বিভিন্ন সীমান্ত প্রদেশে বিশাল সৈন্য সমাবেশ করলেন।
পরে নানান নাটকিয়তা শেষে সূচনা হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের। এরপর ১৯৪৫ সালের শুরুর দিকে জার্মানি সম্পূর্ণ পতনের মুখে ছিলো। পূর্বদিক থেকে সোভিয়েত বাহিনী পোল্যান্ড দখল করে অডের নদী পার হতে প্রস্তুতি নিচ্ছিলো। অপরদিকে মিত্রবাহিনির অন্যান্য সদস্য অন্যান্য দিক দিয়ে জার্মানির অভ্যন্তরে প্রবেশ করছিলো। ২৫ জানুয়ারি নাৎসি জার্মানির সর্বশেষ বড় আক্রমন ‘আরদেন অফেন্সিভ’ ব্যর্থ হয়।
২০ এপ্রিলে বার্লিনে সোভিয়েত গোলন্দাজ বাহিনী বোমাবর্ষণ শুরু করে। ২১ এপ্রিলে তারা বার্লিনে প্রবেশ করতে শুরু করে। ২২ এপ্রিল জেনারেল স্টাইনার হিটলারের আক্রমনের আদেশ পালন করতে ব্যর্থ হন। এই খবর শুনে হিটলার প্রথমবারের মত বুঝতে পারেন যে জার্মানি যুদ্ধে পুরোপুরি হেরে গিয়েছে। তিনি তার সকল সেনাপতিকে বিশ্বাসঘাতক বলেন। সেনাপতিরা তাকে বার্লিন ত্যাগ করে দক্ষিন জার্মানিতে গিয়ে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার আহ্বান করেন।
এতে হিটলার বলেন তারা (সেনাপতিরা) যা ইচ্ছা করতে পারে কিন্তু তিনি বার্লিন ত্যাগ করবেন না। একই সাথে তিনি এসএস বাহিনীর ডাক্তার হাসের কাছে আত্মহত্যার পদ্ধতি নিয়ে জানতে চান। হাস উপদেশ দিলেন পিস্তলের গুলি ও বিষ একই সাথে প্রয়োগ করার জন্য। এসব জানতে পেরে হিটলারের দীর্ঘসময়ের সহযোগী বিমানবাহিনীর প্রধান হারমান গরিং হিটলারের নিকট আবেদন করেন তাকে ক্ষমতা হস্তান্তরের জন্য।
এছাড়া তার অপর দীর্ঘসময়ের সহযোগী হাইনরিখ হিমলার মিত্রবাহিনীর সাথে সন্ধির পদক্ষেপ নেন। কাছের লোকদের এধরনের আচরণে হিটলার আরো ভেঙ্গে পরেন। ২৫ এপ্রিল সোভিয়েত বাহিনী বার্লিন পুরো ঘিরে ফেলে। হিটলার, গয়েবলস ও ফুরারবাঙ্কারের অনেকে আত্মহত্যার প্রস্তুতি নেন। ২৯ এপ্রিল মধ্যরাতে হিটলার তার ১৫ বছরের সঙ্গিনী ইভা ব্রাউন কে বিবাহ করেন। পরে ৩০শে এপ্রিল বার্লিনে মার্টির নিচের বাংকারের ভেতর এডলফ হিটলার এবং তার সদ্যবিবাহিত স্ত্রী ইভা ব্রাউন আত্মহত্যা করেন।
ইভা ব্রাউন সায়ানাইড বিষ পান করেন, আর হিটলার নিজের মাথায় গুলি করেন এবং সম্ভবত সায়ানাইডও গ্রহণ করেছিলেন। দীর্ঘদিনের সঙ্গিনী ইভা ব্রাউনকে তার আগের দিন বাংকারের মধ্যেই বিয়ে করেন হিটলার।
তখন রুশ সৈন্যরা বার্লিন শহরের উপকণ্ঠে ঢুকে পড়েছে, এবং নাৎসী শাসকদের পতন নিশ্চিত হয়ে গেছে।
হিটলারের মৃতদেহ জার্মান সৈন্যরাই বাংকার থেকে বের করে রাইখ চ্যান্সেলরির বাগানে একটি গর্তে ফেলে পেট্রোল ঢেলে আগুনে পুড়িয়ে ফেলে। কিন্তু তার মৃতদেহের কিছু অংশ রুশরা উদ্ধার করে এবং তা মস্কোয় নিয়ে যায়।