আনোয়ার কঙ্গো:যিনি খুন করে আনন্দ পেতেন
অনলাইন ডেস্ক
ইন্দোনেশিয়ার এক ভয়াবহ ভয়ঙ্কর গণহত্যাকারীর নাম আনোয়ার কঙ্গো। তিনি কমপক্ষে ১ হাজারের বেশি মানুষকে হত্যা করেছেন। তবে তার খুনের তালিকা আরো দীর্ঘ বলেই ধারণা অনেকের। খুন করার ক্ষেত্রে তার রয়েছে নিজস্ব পদ্ধতি। এক টুকরো তার গলায় পেঁচিয়ে ধরে মানুষের প্রাণ কেড়ে নিতে পছন্দ করতেন এই ঘাতক। কেননা, পিটিয়ে মারার চেয়ে এই পদ্ধতিটাই কঙ্গোর ঝামেলাবিহীন মনে হত।
কঙ্গোর খুনের ঘটনাবলী নিয়ে নির্মিত হয়েছে তথ্যচিত্র‘দি অ্যাক্ট অব কিলিং’, যা ২০১২ সালের অস্কার লাভ করেছে। সেখানে খুনের পর গণহত্যাকারী আনোয়ার কঙ্গো ধেই ধেই করে নাচতে দেখা যায়। কারণ হিসাবে সে জানায়, ‘আমি সবকিছু ভুলে যেতে চেষ্টা করেছি। একটুখানি নাচের তাল, সুখানুভূতি, একটুখানি মদিরা আর একটুখানি গাঁজা।’ এইটুকু বলতে-বলতে সে গান গাইতে শুরু করে।
বিংশ শতকের অন্যতম ভয়ংকর গণহত্যাগুলোর একটি, ইন্দোনেশিয়ার এই ভয়াবহ হত্যাকাণ্ডগুলোর কথা খুব কম মানুষই জানে।
ইন্দোনেশিয়ায় ১৯৬৫-১৯৬৬ সালে যখন রাজনৈতিকভাবে নিধনযজ্ঞ চলছিল তখন অন্তত ৫ লাখ মানুষের প্রাণসংহার করা হয়েছে। ক্যু করতে ব্যর্থ হয়ে সেনারা সারাদেশের কমিউনিস্টদের উপরে ঝাঁপিয়ে পড়ে ও হত্যা করে। বামপন্থী শত-শত মানুষকে যারা হত্যা করেছে কঙ্গো ছিলেন তেমনি একটি হত্যাকারী দলের অংশ।
তার সেই কুকর্মগুলোকে ক্যামেরার সামনে অভিনয় করে দেখানোর জন্য প্রস্তাব দেয়া হয়েছিল ‘দি অ্যাক্ট অব কিলিং’ তথ্যচিত্রের পক্ষ থেকে। অভিনয়ে কঙ্গো রাজি হলে তাকে অনুসরণ করেছে ‘দি অ্যাক্ট অব কিলিং’টিম।
এ বছর অক্টোবরের ২৫ তারিখে ৭৮ বছর বয়সে আনোয়ার কঙ্গো মারা গিয়েছেন।
কঙ্গোর বেড়ে ওঠা
ইন্দোনেশিয়ার উত্তরাঞ্চলের শহর মেদানের একটি তেলক্ষেত্রের কাছে কঙ্গোর পরিবারের বসবাস। সেখানেই তার বেড়ে ওঠা। আশপাশের লোকজনদের তুলনায় তাদের অর্থনৈতিক অবস্থা ভালো ছিল। ১২ বছর বয়সেই বিদ্যালয়ের পাঠ চুকিয়ে আনোয়ার কঙ্গো মেদানের অপরাধ জগতের সদস্য হয়ে ওঠেন। শুরুর দিকে মেদানের সবচেয়ে জনপ্রিয় সিনেমা হলের আশপাশে থাকতেন। তারপর শুরু করেন সিনেমার টিকিট কালোবাজারির কাজ।
এর অল্প কিছুকালের মধ্যেই আরো গুরুতর সব অপরাধের সাথে জড়িত হয়ে যান তিনি। কালোবাজারি, অবৈধ জুয়া এবং স্থানীয় চাইনিজ ব্যবসায়ীদের থেকে চাঁদা আদায় শুরু করেন।
‘দি অ্যাক্ট অব কিলিং’তথ্যচিত্রের নির্মাতা জোশুয়া ওপেনহেইমার বলেন, কঙ্গো এবং তার বন্ধু আদি জুলকাদরি আততায়ীও ভাড়া করেছিলেন।
এক ডুরিয়ান (বাংলাদেশী কাঁঠালের মতন দেখতে একটি ইন্দোনেশিয়ান ফল) ফল বিক্রেতাকে হত্যাই ছিল তাদের উদ্দেশ্য। কিন্তু সেবার তারা ব্যর্থ হয়।
১৯৬৫ সালে ইন্দোনেশিয়াতে ব্যর্থ ক্যু হবার সময় আসার আগেই আনোয়ার কঙ্গো আর তার বন্ধু-বান্ধব মিলে শতাধিক অপরাধ ও অপকর্মে জড়িয়ে পড়েছে। আর তারা ছিল কমিউনিস্ট বা বামপন্থী বিরোধী।
ইন্দোনেশিয়ার গণহত্যা
সেই কুখ্যাত ণহত্যার নীল নকশা এঁকেছিল সেনাবাহিনী। কিন্তু তা বাস্তবায়ন করেছিল গুণ্ডা-পাণ্ডা এবং ডানপন্থী আধা সামরিক বাহনীর সদস্যরা। আনোয়ার কঙ্গোর দলটাকে নিয়োগ দিয়েছিল সেনাবাহিনী। নিয়োগের পর থেকে তারা শত শত মানুষকে নির্যাতন ও হত্যা করেছে।
দলটার নাম ছিল ‘ফ্রগ স্কোয়াড’(ব্যাঙ বাহিনী)। তারা ছিল ওই অঞ্চলের সবচেয়ে শক্তিশালী হত্যাকারী গ্রুপ। এই গ্রুপের হত্যাকারী হিসেবে আনোয়ার কঙ্গো কুখ্যাত হয়ে ওঠে। হলিউডের সিনেমা দেখে-দেখে কঙ্গো ও তার বন্ধুরা মানুষকে খুন করার নতুন নতুন পদ্ধতি আবিষ্কার করতো। বিশেষ করে আল পাচিনো অভিনীত মাফিয়া সিনেমা এবং জন ওয়েনের ওয়েস্টার্ন সিনেমাগুলো ছিল তাদের প্রিয়।
কঙ্গো তার নিজের হাতে কম করে হলেও হাজার খানেক মানুষকে হত্যা করেছে। সেই সময়ে কঙ্গো কতটা ভয়ানক ছিল ‘দি অ্যাক্ট অব কিলিং’তথ্যচিত্রে সেই স্মৃতি রোমন্থন করেছেন উত্তর সুমাত্রার গভর্নর শামসুল আরেফিন।
শামসুল আরেফিন বলছিলেন, ‘সবাই তাকে (কঙ্গো আনোয়ার) ভয় পেতো। তার নাম শুনলেই লোকে ভয়ে সেঁধিয়ে যেতো।’
রাজনৈতিক নিধনযজ্ঞের এই সময়টা ইন্দোনেশিয়াতে খুবই স্পর্শকাতর একটা ইস্যু। কমিউনিস্ট পার্টির সাথে সম্পৃক্ত থাকার কারণে সেই সময়ে লাখ খানেক মানুষকে কারাবন্দি করা হয়। কিন্তু আনোয়ার কঙ্গো ও তার বন্ধুদের মতন অপরাধীদের কখনোই কোনো জবাবদিহিতার মুখোমুখি হতে হয়নি। বরং তিনি তখন ছিলেন ইন্দোনেশিয়ার সরকারপন্থী দল, ‘দি প্যানকাসিলা ইয়ুথ’-এর সম্মানিত নেতা।
মেদানের সর্ববৃহৎ নৈশ ক্লাবের নিরাপত্তারক্ষীদের প্রধান হিসেবে ১৯৯০ এর দশকে আনোয়ার কঙ্গো কাজ করেছে। কিন্তু এই কোম্পানির নামের আড়ালে সে আসলে মাদকের কারবার করতো। তার সংগঠনে কঙ্গোকে আনুষ্ঠানিকভাবে উপাধিও দেয়া হয়েছে এবং ষাটের দশকের সেই হত্যাকাণ্ডের ভূমিকার জন্য তাকে অত্যন্ত সম্মান, শ্রদ্ধা ও স্মরণ করা হয়।
প্রদিতা সাবারিনি বিবিসিকে বলছিলেন, সেই সময় তাদেরকে স্কুলে শেখানো হতো ‘কমিউনিস্টরা খারাপ’, ‘তারা নাস্তিক’ ও তারা জাতির সাথে ‘বিশ্বাসঘাতকতা’করেছে।
তিনি বলেন, ‘বিদ্যালয়ে আমাদের কী শেখানো হচ্ছে তা নিয়ে আমরা কখনো প্রশ্ন করিনি। এমনকি বিরাট সংখ্যাক বামপন্থীদের যখন গণহারে হত্যা করা হলো সেটি জানার পরেও আমার মনে হয়েছে; তারা তো সব বামপন্থী। তাই তাদের মেরা ফেলা ঠিকই আছে।’
যেভাবে কঙ্গোর তথ্যচিত্রে আসা
ফিল্মের একজন কর্মী আনোয়ার কঙ্গোকে খুঁজে বের করে এবং সে যে কুকীর্তি করেছে সেগুলোর মুখোমুখি করে এবং বিবেকের সামনে দাঁড় করায়। তবে, শুরুতে সে ছিল বেশ অহংকারী।
ওপেনহেইমারের সাথে কঙ্গোর প্রথম সাক্ষাৎ হয় ২০০৫ সালে। তখন সাবেক এই হত্যাকারী একে-একে তার খুনের পদ্ধতিগুলো তুলে ধরে। তথ্যচিত্রটিতে কঙ্গো ও তার বন্ধুদের অনুসরণ করা হয়েছে। এই তথ্যচিত্রে তারা তাদের হত্যাকাণ্ডের স্মৃতি রোমন্থন করেছে এবং খুনের পদ্ধতিগুলো তুলে ধরেছে।
তারা নিজেরাই ওই তথ্যচিত্রের পাণ্ডুলিপি লিখেছেন, নিজেরাই অভিনয় করেছেন এবং নিজেদের প্রিয় সিনেমাগুলোর আদলে সেগুলোকে প্রকাশ করেছে। চাইনিজ মানুষদের খুন করা নিয়ে আনোয়ার কঙ্গো নিয়মিত ঠাট্টা-মস্করা করতো।
তথ্যচিত্রটিকে একসাথে কাজ করার শুরুর দিকে আনোয়ার কঙ্গো বলেছেন, ‘তরুণ বয়সে কী করেছি সেই গল্পই বলবো’। তবে, সময় যত এগিয়েছে, ধীরে ধীরে তাদের মধ্যে বিবেকের উদয় হয়েছে।
এক পর্যায়ে কঙ্গো এটাও স্বীকার করে যে, একসময় রাতে সে নিয়মিত দুঃস্বপ্ন দেখতেন। তিনি বলেন, ‘আমার ঘুমে খুব ব্যাঘাত ঘটছে। কী জানি, গলায় প্যাঁচ দিয়ে শ্বাসরুদ্ধ করে মেরে ফেলার সময় আমি তাদের মরতে দেখি বলেই হয়তো এমন হয়েছে।’ তথ্যচিত্রটির একেবারে শেষ দিকের একটি দৃশ্যে কঙ্গো নিজেই একজন আক্রান্ত ব্যক্তির ভূমিকায় অভিনয় করেছে।
সেই দৃশ্যে তার গলায় রশি পেঁচিয়ে শ্বাসরোধ করা হয়
তখন তিনি ক্যামেরা বন্ধ করতে বলে এবং খুব চুপচাপ বসে থেকে জিজ্ঞেস করে, ‘আমি অপরাধ করেছি?’ পরবর্তীতে আবার যখন এই দৃশ্য দেখেন তখন খানিকটা অশ্রুসজল চোখে বলছিলেন, ‘কত মানুষের সাথে আমি এমন করেছি!’
‘দি অ্যাক্ট অব কিলিং’র নির্মাতা ওপেনহেইমার বলছিলেন, ‘তথ্যচিত্রটিতে কাজ করতে গিয়ে এক পর্যায়ে তার মধ্যে অপরাধবোধ দেখা দেয়। মানুষ তার নিজের কৃতকর্মের মাধ্যমেই নিজেকে ধ্বংস করে। আর এটাই হচ্ছে এই তথ্যচিত্রের মূল বার্তা।’
সূত্র: বিবিসি বাংলা