সোমবার, ৭ অক্টোবর ২০১৯
প্রথম পাতা » অপরাধ ও দুর্নীতি » অপারেশনের নাট-বল্টু বিক্রি করেই কোটিপতি নার্স!
অপারেশনের নাট-বল্টু বিক্রি করেই কোটিপতি নার্স!
সিলেট প্রতিনিধি
সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের অঘোষিত ‘সম্রাট’ স্টাফ নার্স ইসরাইল আলী সাদেকের কাছে জিম্মি হয়ে আছে সাধারণ রোগীরা। শুধু রোগীই নয়, হাসপাতালের অনেক স্টাফও তার কাছে জিম্মি। আশ্চর্যের বিষয় হলো এ হাসপাতালে অর্থপ্যাডিক বিভাগের হাড়ের অপারেশনে ব্যবহৃত ধাতু দিয়ে তৈরি বিশেষ ধরনের পাত, তার, স্ক্রু, বল ইত্যাদি অবৈধ সিন্ডিকেটের মাধ্যমে বিক্রি করেই এখন তিনি কোটিপতি!
অস্ত্রোপচার করে ভাঙা হাড় জোড়া লাগাতে প্রয়োজন ধাতু দিয়ে তৈরি বিশেষ ধরনের পাত, তার, স্ক্রু, বল ইত্যাদি। যাকে মেডিকেল সায়েন্সের ভাষায় বলে অর্থপেডিক ইমপ্ল্যান্ট। কিন্তু সাদেকের দখলে থাকা হাসপাতাল অভ্যন্তরের ‘ন্যায্যমূল্যের ওষুধের দোকান’ ছাড়া অন্য কোথাও গুরুত্বপূর্ণ এ অপারেশনের যন্ত্রাংশ পাওয়া যায় না। আর পেলেও এসব যন্ত্রাংশ দিয়ে অপারেশন হয় না ওসমানী হাসপাতালে। মানে হাড় জোড়া লাগাতে হলে যে কোনো মূল্যেই ন্যায্যমূল্যের দোকান থেকে কিনতে হবে এসব যন্ত্রাংশ। কিন্তু কেন এমন অদ্ভুত নিয়ম? অনুসন্ধানে উঠে আসে নানা তথ্য।
জানা যায়, সিন্ডিকেটের মাধ্যমে কৌশলে এমন নিয়ম গড়ে তুলেছেন ওসমানী হাসপাতালের স্টাফ নার্স বাংলাদেশ নার্সেস এসোসিয়েশন (বি.এন.এ) সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল শাখার সাধারণ সম্পাদক ইসরাইল আলী সাদেক। যার বিনিময়ে তিনি প্রতি মাসে কামাচ্ছেন লাখ লাখ টাকা। প্রায় দ্বিগুণ, ক্ষেত্র বিশেষে ৩ গুণ দাম আদায় করে বছরে তিনি কোটি টাকা হাতিয়ে নেন।
কী করে সাদেকের এমন সিণ্ডিকেট? অনুসন্ধানে নেমে প্রথমেই গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া যায় ইসরাইল আলী সাদেকের দূর সম্পর্কের এক ভাগনের কাছ থেকে। পরিচয় গোপন রেখে কৌশলে তার এ ভাগনের সাথে কথা বললে তিনি বলেন, সাদেক সম্পর্কে আমার মামা। হাসপাতালে আল্লাহর রহমতে তার ভালোই ক্ষমতা। টাকা পয়সাও কামিয়েছেন অনেক।
কী করে এত টাকা কামালেন; এমন প্রশ্নের উত্তরে এক বাক্যেই তিনি বলেন, হাড়ের অপারেশনের নাট-বল্টু বিক্রি করে তিনি মাসে যে টাকা কামান তার হিসাব করে শেষ করা যাবে না। কারণ উনার নাট-বল্টু ছাড়া ওসমানীতে কোনো অপারেশন হয় না।
তার ভাগনের কাছ থেকে প্রাপ্ত তথ্য মতে রোগীর স্বজন সেজে ওসমানী হাসপাতাল এলাকার প্রায় সব ফার্মেসিতে অপারেশনের এসব যন্ত্রাংশের খোঁজ করলে কোথাও তা পাওয়া যায়নি। তাদের কাছে এসব যন্ত্রাংশ না মেলার কারণ হিসেবে তারা জানালেন, ওসমানী হাসপাতালে সাদেকের যন্ত্রাংশ ছাড়া কোনো অপারেশন হয় না। তাই তারা এসব যন্ত্রাংশে টাকা বিনিয়োগ করতে চান না। একই সাথে ন্যায্যমূল্যের ওষুধের দোকান সাদেকের এবং সেখানেই কেবল এসব যন্ত্রাংশ বিক্রি হয় বলে তারা জানান।
কিন্তু এমন নিয়ম কেন এমন প্রশ্নের উত্তরে তারা জানান, সাদেকের সাথে ডাক্তার, নার্সসহ সবার একটা চুক্তি আছে। নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে অধিক মূল্যে সাদেক এসব যন্ত্রাংশ বিক্রি করেন। যার একটা অংশ সংশ্লিষ্ট সবাই পায়।
বিভিন্ন ফার্মেসিতে ঘুরে এ সম্পর্কিত বেশ কয়েকটি রেকর্ড সংগ্রহ করা হয়।
বিভিন্ন ফার্মেসিতে কথা বলার পর হাসপাতালের অভ্যন্তরে থাকা ন্যায্য মূল্যের ওষুধের দোকানে যান এ প্রতিবেদক। পরিচয় গোপন রেখে পাতের দাম জানতে চাইলে ফার্মেসিতে থাকা একজন লিস্টে নাম আছে কি না জানতে চান। তখন এ প্রতিবেদক কিসের লিস্ট জানতে চাইলে ফার্মেসির ওই কর্মকর্তা বলেন, হাসপাতালের লিস্ট আছে। লিস্টে নাম আসলে আসবেন, দাম বলবো। এমনকি লিস্টে নাম থাকলে হাসপাতাল থেকেই তাদের কাছে জানানো হবে বলেও জানান ফার্মেসির এ কর্মচারী।
ন্যায্যমূল্যের ওষুধের দোকান কার?
অনুসন্ধানে জানা যায় প্রত্যক্ষভাবে এ দোকানের মালিক সাদেকের ভাই। কিন্তু পরোক্ষভাবে এর নিয়ন্ত্রক সাদেক নিজে। কেবল হাড়ের অপারেশনেরই নয়, অপারেশনের কাজে ব্যবহারের গুরুত্বপূর্ণ সব কিছুই এ দোকান থেকে কেনার কথা বলেন সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। মূলত সাদেক সিন্ডিকেটেই এমন অদ্ভুত অনিয়মের ‘নিয়ম’ এখন ওসমানী হাসপাতালে প্রচলিত। সাদেকের এমন নিয়মের সাথে যারা জড়িত তারা আর্থিকসহ নানাভাবে উপকৃত হন। আর যারা এমন অনিয়মের বিরোধিতা করেন তাদের পড়তে হয় নানা সমস্যায়।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে হাসপাতালের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, দীর্ঘদিন থেকে একজন ইজারাদার কীভাবে ইজারা নিয়ে এ ফার্মেসি পরিচালনা করে তা সবার কাছেই পরিষ্কার। তাছাড়া সাদেক মূলত একটা সিন্ডিকেট করে অনিয়মকেই নিয়মে পরিণত করেছে। আর ভোগান্তিতে পড়ছে সাধারণ মানুষ।
তবে সব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন ইসরাইল আলী সাদেক। তিনি বলেন, এসব অভিযোগ সত্য নয়। আমি এর কিছু জানি না।
এসব ব্যাপারে যোগাযোগ করা হলে সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের উপ-পরিচালক, ডা. হিমাংশু লাল রায় বলেন, আমি নতুন এসেছি। তাই এ ব্যাপারে কোনো মন্তব্য করতে পারছি না।
বিষয়টি নিয়ে বাংলাদেশ জার্নালের পক্ষ থেকে যোগাযোগ করলে সিণ্ডিকেটের বিষয়টি স্বীকার করেন ওসমানী হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ইউনুসুর রহমান। তিনি বলেন, এসব ব্যাপার আমি তেমন একটা জানি না। সংশ্লিষ্ট বিভাগের প্রফেসরের সাথে যোগাযোগ করলে তিনি ভালো বলতে পারবেন। তবে সকল হাসপাতালেই একটি সিন্ডিকেট থাকে। এ সিন্ডিকেটই মূলত এমন অনিয়ম করে। আমরা চাচ্ছি এসব সিণ্ডিকেট দূর করতে। খোঁজ খবর নিয়ে ব্যবস্থা নেয়া হবে বলেও জানান তিনি।
এ ব্যাপারে অর্থোপ্যাডিক বিভাগের প্রধান ডা. শংকর কুমারের সাথে যোগাযোগ করতে তার মোবাইল ফোনে একাধিকবার চেষ্টা করা হলেও তা বন্ধ পাওয়া যায়।
প্রসঙ্গত, গত ৩ অক্টোবর রাত ৯টা ২০ মিনিটের সময় সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশের মোগলাবাজার থানার আওতাধীন আলমপুর এলাকা থেকে ইসরাইল আলী সাদেক ও নগরীর উত্তর বালুচর এলাকার বাসিন্দা মৃত দৌলত আহমদের ছেলে ওমর ফারুককে আটক করে র্যাব। এসময় তাদের প্রত্যেকর কাছ থেকে ৫ টা করে মোট ১০টি প্যাথিড্রিন উদ্ধার করা হয়।
ঘটনার সময় তাদের ব্যবহৃত একটি প্রাইভেট কারও জব্দ করা হয়। এরপর ৪ অক্টোবর সকাল ৭টা ৪০ মিনিটে তাদেরকে মোগলাবাজার থানা পুলিশের কাছে হস্তান্তর করে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন-২০১৮ এর ধারা ৩১ (১) ও ৮ (খ) অনুযায়ী বিক্রয়ের উদ্দেশ্য প্যাথিড্রিন বহনের কথা উল্লেখ করে র্যাব-৯ এর এসআই মো. আব্দুল মালিক বাদী হয়ে একটি মামলা দায়ের করেন। যার নং-৪।
এদিকে ৪ অক্টোবর র্যাবের পক্ষ থেকে থানায় হস্তান্তর করার পর মোগলাবাজার থানা পুলিশ তাকে আদালতে পাঠালে মহানগর ম্যাজিস্ট্রেট আদালত ২য় এর বিচারক মামুনুর রহমান তার অন্তর্বর্তীকালীন জামিন মঞ্জুর করেন।