সেই তুহিন হত্যার আড়ালে কে?
সুনামগঞ্জ প্রতিনিধি
সুনামগঞ্জের শিশু তুহিন হত্যাকাণ্ডের পরপর পুলিশ জানিয়েছিল এ ঘটনায় তার বাবা-চাচা জড়িত। কিন্তু দুই দফায় আট দিন রিমান্ডে নিয়েও তাদের কাছ থেকে স্বীকারোক্তি আদায় করা যায়নি। এখন সাড়ে ৫ বছর বয়সী শিশু তুহিন হত্যায় বাবার সম্পৃক্ততা নিয়ে ধোঁয়াশার সৃষ্টি হয়েছে জেলাজুড়ে। তাহলে এই হত্যার আড়ালে কে?
দিরাই উপজেলায় রাজনগড় ইউনিয়নের কেজাইড়া গ্রামের শিশু তুহিন হত্যায় তার মা, চাচিসহ এলাকাবাসী সুষ্ঠু ও অধিকতর নিরপেক্ষ তদন্তের দাবি জানিয়েছেন।
এলাকার কেউ কেউ প্রশ্ন তুলছেন, বাবা কি আসলেই সন্তানের হত্যাকারী? না এর আড়ালে লুকিয়ে আছে অন্য কোনো গল্প? এমন কি হতে পারে হত্যাকারীরা ঘটনা এমনভাবে সাজিয়েছে যাতে মনে হতে পারে প্রতিপক্ষকে ফাঁসাতে বাবা-চাচারা তুহিনকে খুন করেছে?
তুহিনের বাবা ও দুই চাচা তুহিন হত্যায় নিজেদের সংশ্লিষ্টতা অস্বীকার করছেন, এদিকে ঘটনার ১১ দিন পরও মামলার এজাহার প্রকাশ করেনি পুলিশ। এ নিয়ে চলছে কানাঘুষা। তবে তুহিনের লাশ উদ্ধারের দিন জিজ্ঞাসাবাদের জন্য থানায় নেওয়া তুহিনের তিন চাচার মধ্যে একজন এবং এক চাচাতো ভাই স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন গত ১৭ অক্টোবর।
এদিকে প্রথম ও দ্বিতীয় দফা রিমান্ড শেষে শনিবার কারাগারে পাঠানো হয় তুহিনের বাবা আব্দুল বাছির এবং দুই চাচা আব্দুল মছব্বির ও জমশেদ আলীকে।
প্রথম দফা তিন দিনের রিমান্ডে তুহিনের বাবা ও দুই চাচার কাছ থেকে কোনো স্বীকারোক্তি পায়নি পুলিশ। গত সোমবার দ্বিতীয় দফায় বাবা আব্দুল বাছিরকে পাঁচ দিন এবং দুই চাচাকে তিন দিনের রিমান্ডে নেয় দিরাই থানার পুলিশ। দ্বিতীয় দফা রিমান্ড শেষে তুহিনের দুই চাচাকে গত বৃহস্পতিবার এবং বাবা আব্দুল বাছিরকে শনিবার আদালতে হাজির করে পুলিশ। আদালত তাদের কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন।
রিমান্ড শেষে আদালতে ১৬৪ ধারায় তুহিনের বাবা ও দুই চাচার জবানবন্দি সম্পর্কে জানতে চাইলে পুলিশ তদন্তের স্বার্থে এখন কিছু জানাতে অপারগতা জানায়।
তবে আদালত সূত্রে জানা যায়, তুহিনের বাবা ও দুই চাচার কাছ থেকে এখন পর্যন্ত কোনো স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি পাওয়া যায়নি।
যে বা যারাই তুহিনকে খুন করুক, এটা স্থানীয় গোষ্ঠী দ্বন্দ্বের জের, এ ব্যাপারে নিঃসন্দেহ স্থানীয় এলাকাবাসী। এই সন্দেহের ভিত্তি হিসেবে তারা গত কয়েক বছরের ঘটনাপরম্পরা তুলে ধরেন।
বছর চারেক আগে গ্রামের আধিপত্যকে কেন্দ্র করে আব্দুল বাছিরের গোষ্ঠীর লোকজনের সঙ্গে প্রতিপক্ষ আনোয়ার মেম্বরের লোকজনের সংঘর্ষ হয়। এ ঘটনায় উভয় পক্ষ মামলা করে থানায়। এরই মাঝে আব্দুল বাছিরের স্বজন গিয়াস উদ্দিন স্ত্রী নিলুফা বেগমকে নিয়ে নিজ বাড়ি থেকে একই গ্রামে শ্বশুরবাড়ি যাওয়ার সময় প্রতিপক্ষের হামলার শিকার হন। পরদিন নিলুফা বেগম চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান।
এ ঘটনায় নিলুফা বেগমের বাবা বাদি হয়ে প্রতিপক্ষ আনোয়ার মেম্বরসহ ১৬ জনকে আসামি করে থানায় হত্যা মামলা করেন। এ মামলায় আদালতে সাক্ষ্য চলছে। আনোয়ার মেম্বরসহ আসামিরা দীর্ঘদিন কারাভোগের পর জামিনে বের হয়ে বসবাস করছেন তুহিনের বাড়ির আশপাশে। মামলায় অভিযুক্ত কেউ কেউ ভয়ে দেশ থেকে পালিয়ে গেছে।
তুহিন হত্যাকাণ্ডের তিন দিন আগে আনোয়ার মেম্বর একটি চেক ডিজঅনার মামলায় এক বছর সাজা ভোগ করে জেল থেকে বেরিয়ে আসেন। তাই নিলুফার হত্যার সঙ্গে তুহিন হত্যাকাণ্ডের কোনো যোগসূত্র লুকিয়ে আছে কি না তা খতিয়ে দেখার দাবি জানান এলাকাবাসী।
তুহিন হত্যাকাণ্ডের পরদিন পরিবারের লোকজনকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য থানায় নেওয়ার তিন ঘণ্টার মাথায় মৌখিকভাবে পরিবারের তিনজন এবং পরদিন আনুষ্ঠানিক সংবাদ সম্মেলন করে সুনামগঞ্জের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. মিজানুর রহমান জানান তুহিন হত্যায় চাচার সঙ্গে বাবাও জড়িত।
কিন্তু তা মানতে নারাজ তুহিনের মা মনিরা বেগম। তার স্বামী জড়িত থাকতে পারেন বলে বিশ্বাস করেন না তিনি। নিরপেক্ষ ও অধিকতর তদন্তের মাধ্যমে খুনিদের বের করার দাবি জানান তুহিনের মা।
সুনামগঞ্জ জেলা ও দায়রা জজ আদালতের পিপি সাবেক এমপি অ্যাডভোকেট শাহানা রব্বানীও এমনটাই মনে করেন। বলেন, ‘আর যারাই হত্যা করুক, অন্তত তুহিনের বাবার পক্ষে এই হত্যাকাণ্ডের পরিকল্পনা করা সম্ভব নয়।’
তুহিন হত্যার ঘটনায় তাদের প্রতিপক্ষের লোকজনকেও জিজ্ঞাসাবাদ করা দরকার বলে মনে করেন সোনামগঞ্জ জেলা ও দায়রা জজ আদালতের সিনিয়র আইনজীবী অ্যাডভোকেট স্বপন কুমার দাস। তিনি বলেন, ‘শুধু পিতা বা চাচা নয়, প্রকৃত যারা খুনি বা তৃতীয় কোনো পক্ষ সুবিধা নিতে চায় কি না, এমনকি প্রতিপক্ষের লোকদেরও জিজ্ঞাসাবাদের প্রয়োজন আছে।’
কিন্তু প্রতিপক্ষের লোকজনকে এখন পর্যন্ত জিজ্ঞাসাবাদের কোনো তথ্য জানা যায়নি।
এ ব্যাপারে সুনামগঞ্জ পুলিশ সুপার মিজানুর রহমান বলেন, তুহিন হত্যায় আর কেউ জড়িত আছে কি না বলা যাচ্ছে না। বিষয়টি এখনো তদন্তাধীন। এই মামলায় তদন্তে যাদের নাম আছে তাদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য-প্রমাণ সংগ্রহ করে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব চার্জশিট দাখিল করা হবে।
গত ১৫ অক্টোবর ভোররাতে বাড়ির মসজিদের পাশে কদমগাছে ঝুলন্ত অবস্থায় পাওয়া যায় শিশু তুহিনের লাশ। তাতে ভয়াবহ নৃশংসতার চিহ্ন রেখে যায় খুনিরা। তার পেটে বিদ্ধ অবস্থায় দুটি ছুরি। কেটে ফেলা হয়েছে দুই কান ও লিঙ্গ। গলাও কাটা।
পেটে বিদ্ধ দুটি ছুরিতে গ্রামের সালাতুল ও সোলেমানের নাম লেখা। এ থেকে ধারণা করা হয় প্রতিপক্ষ লোকজনকে ফাঁসানোর জন্য তুহিনের বাবা-চাচারা পরিকল্পিতভাবে এই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছেন। তাই তুহিনের বাবা, তিন চাচা, চাচাতো ভাই, চাচি ও চাচাতো বোনকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য থানায় নিয়ে যায় পুলিশ। ওই দিন রাতে তুহিনের মা মনিরা বেগম বাদী হয়ে অজ্ঞাতনামা ১০-১২ জনকে আসামি করে থানায় মামলা করেন।
১৭ অক্টোবর তুহিনের চাচি ও চাচাতো বোনকে ছেড়ে দিয়ে বাবা আব্দুল বাছির, চাচা মওলানা আব্দুল মোছাব্বির, নাসির, জমসেদ ও চাচাতো ভাই শাহরিয়ারকে আদালতে পাঠায় পুলিশ। আদালতে চাচা নাসির ও চাচাতো ভাই শাহরিয়ার ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন।