আলম মাঝির নদী ভাঙনের গল্প
আমজাদ হোসেন আমু, লক্ষ্মীপুর প্রতিনিধি,
আলম মাঝি, বয়স ৫৫ এর কাছাকাছি। নদীতে জাল পেলে নৌকায় মাছ ধরে বউ-পোলাপাইন নিয়া জীবন চালায়। ছেলে তামিম বয়স ১২, স্থানীয় আলোর ভূবন স্কুলে ৭ তম শ্রেণিতে পড়ে। বাবার সাথে জাল বুনছে। এক সাথে বাবা-ছেলে মাছ ধরতে কাজ করছে। যা দিয়ে সংসার চলছে আলম মাঝির। তামিম স্কুলে পড়ে। স্কুল বন্ধ হলে মাঝে-মধ্যে মাছ ধরতে যায়। এখন রীতিমত স্কুল থাকলেও বাবার সাথে নদীতে মাছ ধরে। স্কুলে পরীক্ষার সময় শুধু অংশগ্রহন করে।
আলম মাঝির সাথে কথা হলে তিনি বলেন, নদীতে মাছ ধরে সংসার চলে। এক মেয়ে ও এক ছেলের সংসার। মেয়ে স্থানীয় মাদ্রাসায় দ্বাদশ শ্রেণিতে পড়ছে। ছেলে স্কুলে ৭ তম শ্রেণিতে পড়ছে। ছেলে-মেয়ে নিয়ে খুব সুন্দর জীবন-যাপন করছে। কিন্তু এখন আর সুন্দর জীবন চলে না। সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। নদীতে মাছ কম, যেটুকু মাছ পায় তাতে সংসার, ছেলে-মেয়ের লেখা-পড়া ও ধার-দেনা চলে না। নদীতে বাড়ি-ঘর ও ফসলি জমি দু’বার ভেঙেছে। এখন তৃতীয় বার ভাঙনের মুখে। বারবার নদীতে নি:স্ব হচ্ছে। এখন আগের মত আয়-রোজগার নেই। বাড়ি ভাঙলে কই যামু। মেয়েটার বিয়ে দিতে পারেনি। নদী ভাঙনের পর মেয়ে বিয়ে কিভাবে দিবে, বুঝতে পারছে না। ছেলেটার স্কুল খোলা, স্কুল রেখে সাথে মাছ ধরতে নিয়ে আসি। তার ভবিষ্যৎ নষ্ট করছি।
নদীতে বাড়ি-ঘর ভাঙলেও ছেলে-মেয়ের তো পড়া-লেখা বন্ধ করা যাবে না। তাই মাঝেমধ্যে পোলারে নিয়া নদীতে মাছ ধরতে যায়। এছাড়া তো কোন উপায় নেই। একার আয়ের সংসার চলে না। ভবিষ্যৎ অন্ধকার হচ্ছে। টাকা ছিল, নদী ভাঙনের পরে জমি কিনে বাড়ি করেছি। কিন্তু এবার ভাঙলে কি করমু..?বুঝতে পারছি। মেঘনা নদীতে বারবার ভাঙনের কারণে অন্যকোন কাজও করা যায় না। গবাদিপশু পালন বা ফসল উৎপাদন করা সহ বিভিন্ন কাজ থেকে বিরত থাকতে হয়।
মেঘনার ভাঙনে বারবার নিঃস্ব শুধু বাড়ি-ঘর হয়নি। সংসারে আপনজনরাও হয়েছে। বাবা-মা, ভাই-বোনসহ আত্মীয় স্বজনরা আলাদা হয়েছে। মায়াবন্ধন ছিন্ন হচ্ছে। সবার প্রতি আন্তরিকতা কমে যাচ্ছে। এতে অনেক আত্মীয় অসুস্থ হয়ে মৃত্যু বরণ করেছে। অনেকে জীবিত রয়েছে তবে মৃতের মত…। তার পরিবারে সবাই বিভিন্ন স্থানে যে যার মত বাড়ি করে থাকছে। কেউ কেউ টাকা-পয়সার অভাবে বাড়ি নির্মান করতে পারেনি। অন্যর আশ্রয়ে বসবাস করছে। কথাগুলো বলছে আর দীর্ঘ নিঃশ্বাস পেলছে আলম মাঝি।
ছেলে-মেয়ের ভবিষ্যৎ নদী ভাঙনে বিলীন হচ্ছে। স্বপ্ন এখন আর স্বপ্ন নেই। স্বপ্ন দুঃস্বপ্ন হচ্ছে। নিজের বাপদাদার সব সম্পত্তি ভেঙে গেছে। নিজের কেনা বাড়ি-ঘর দু’বার ভাঙছে। এখন আবার ভাঙনের পথে। চোখে-মুখে হতাশ লাগছে। তবে কষ্ট হলেও কিছু করতে পারবো না।
নদীতে বাড়ি-ঘর ভাঙছে এতে কোন রাগ-ক্ষোভ নেই। আল্লাহ নিলে তো আর কিছু করার নেই। অভিমান করে কথা গুলো বলছে আলম মাঝি..। বর্তমান বাড়ি ভাঙবে না, কারণ সরকার নদী ভাঙন রোধে বরাদ্দ দিয়েছে। সে আশায় ছিলাম। কিন্তু এখন আর আশা নেই। নদী ভাঙন রোধে কোন কাজ হচ্ছে না। হবেও না..। হলেও তার কি লাভ..?
আলম মাঝির বাড়ি লক্ষ্মীপুরের কমলনগর উপজেলার মেঘনা নদীর উপকূলীয় অঞ্চলের চর ফলকন পাতারচর গ্রামে। প্রথম বাড়ি নদীতে ভাঙার পর অল্প কিছু দুরে এসে আবার বাড়ি নির্মান করেন। এক বছরে নতুন বাড়িসহ চার মাইল জমি নদীতে ভেঙে যায়। পূর্নরায় ৩ মাইল দুরে এসে বর্তমান বাড়ি নির্মান করেন। কিন্তু দুঃখের বিষয় বর্তমান বাড়িও ভাঙনে মুখে…। বিগত সাত বছরে ৩ বার বাড়ি-ঘর মেঘনা নদীতে ভাঙছে।
আলম মাঝির মত কত শত মাঝিদের জীবন সংসার মেঘনা নদীর ভাঙনে বিলীন হচ্ছে তার কোন নির্দিষ্ট হিসেব নেই। প্রতিনিয়ত তারা ভাঙনের মুখে নিমজ্জিত হচ্ছে।
প্রসঙ্গত, বিগত তিনযুগেরও বেশি সময় ধরে মেঘনার ভাঙনে কবলিত রামগতি-কমলনগর উপজেলা ৩৭ কিমি ভূমি। চোখের পলকে ভাঙছে ফসলি জমি,ঘর-বাড়ি। ভাঙন রোধে একনেক থেকে প্রায় ৩১শ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়। কিন্তু দুঃখের বিষয় বরাদ্দের দেড় বছরেও কাজের কোন নিশানা নেই। কিছু ভূয়া ঠিকাদার নিয়োগ দিলেও তারা কাজ করছে না। ফান্ড নেই, বালু নেই, সরজ্ঞাম নেই ইত্যাদি অজুহাতে কাজ বন্ধ করে রেখেছে। এভাবে ভাঙতে থাকলে দেশের মানচিত্র থেকে কমলনগর উপজেলা নামে কোন ভূমি স্বত্ব পাওয়া যাবে না বলে স্থানীয়রা জানান।