সাংবাদিকতা হতে হবে ফ্যাশন - নাঈমুল ইসলাম খান
বিশেষ ডেস্ক : সাংবাদিকতা গোড়া থেকে ছিলো ব্যক্তির ফ্যাশন, এটা পরবর্তীতে হয়েছে প্রফেশন। কিন্তু আমার ধারণা আগামীতে সাংবাদিকতায় প্রাণ প্রাচুর্য ফিরিয়ে আনতে পুনরায় প্যাশন ফিরিয়ে আনতে হবে, সাংবাদিকতার স্বার্থেই। প্যাশনের সাথেই সম্পর্ক নিবেদিত মন, স্বতঃস্ফূর্ততা, সৃজনশীলতা এবং গুনগত উৎকর্ষের।
যেমন একজন কবি তার ফ্যাশন থেকেই কবিতা চর্চা করেন। তারা প্রত্যেকেই প্রথমে তাদের প্যাশন থেকে কাজ শুরু করেন। তারা কবিতাচর্চাকে প্রফেশন হিসেবে নেওয়ার কথা ভাবেন না। যদি জীবিকা হয়, ভালো। কারো কারো ক্ষেত্রে এই ফ্যাশন থেকে যথেষ্ট রোজগার হয় কিন্তু অনেকেরই হয় না।
সাংবাদিকতাতেও আমাদেরকে এই বাস্তবতা অনুধাবন করতে হবে যে প্রফেশন হিসেবে নিয়ে অনেকেই এতে সফল হবেন, কিন্তু সবাই না। আরও অনেকে থাকবেন বা থাকার সুযোগ করে দিতে হবে যারা ফ্যাশন থেকে করবেন, এটাকে প্রফেশন হিসেবে নেবেন না।
এইরকম প্যাশনেট জার্নালিস্ট এবং প্রফেশনাল জার্নালিস্টের সম্মিলিত প্রচেষ্টাতেই সাংবাদিকতা আগামীতে আরও সমৃদ্ধ এবং সাসটেইনেবল বা টেকসই হতে পারে। হাউএভার এমাং আদার থিংজ।
এখন প্রশ্ন হতে পারে একজন প্যাশনেট জার্নালিস্ট কীভাবে জীবিকা নির্বাহ করবেন। ঠিক সেভাবে, যেমন একজন প্যাশনেট কবি পেশা হিসেবে আমলাতন্ত্রকে নেন কিংবা কেউ ব্যাংকার হন। আমলা হয়েও তিনি সেরা সাহিত্যিক হচ্ছেন, কবি হচ্ছেন । ব্যাংকার হয়েও সেরা লেখক হচ্ছেন, কবি হচ্ছেন। এভাবে সাংবাদিকদের মধ্যে অনেকেই থাকবেন তারা হয়তো ব্যবসায়ী কিন্তু সঙ্গে সাংবাদিকতাকে ফ্যাশন বিবেচনা করবেন। ব্যাংকার সাংবাদিকতাতে প্যাশনেটলি বিচরণ করবেন। আমলা, তথাপী সাংবাদিকতাতে প্যাশনেট অংশগ্রহণ করবেন। এই রকম করে ক্ষুদ্র, মাঝারী কিংবা বড় ব্যবসায়ীও সাংবাদিকতা করবেন।
আমার এই আইডিয়াটি সাংবাদিকতার টেকসই উন্নয়নের জন্য আলোচনার প্রস্তাব রাখছি। আমরা যদি স্থির কিংবা বদ্ধ জলাশয়ের ভেতরে থেকে চিন্তা করি তবে এই ব্যবস্থাটাকে সমর্থন করা কঠিন হতে পারে। কিন্তু কেউ যদি বিজ্ঞান মনষ্ক, মুক্ত এবং উদার মনে চিন্তা করেন তাহলে এর মধ্যে একটা বাস্তব সমাধান রয়েছে।
বাংলাদেশের জেলা এবং উপজেলা পর্যায়ে যারা সাংবাদিকতা করেন তাদের ওভারহয়েলমিং মেজরিটি আসলে ফ্যাশন থেকে সাংবাদিকতা করেন। তাদেরকে অল্প ক্ষেত্রে কিছু বেতন দেওয়া হলেও তা তাদের জীবিকা নির্বাহের জন্য একেবারেই যথেষ্ট নয়। অধিকাংশতো কোনো বেতনই পাচ্ছেন না। হয়তো যাতায়াতের খরচ পেয়ে থাকেন কেউ কেউ। কিন্তু তারা তো বাংলাদেশের সবচেয়ে নিবেদিত সাংবাদিক। এবং এটা ফ্যাশন থেকেই।
আমি আমার সাংবাদিকতা প্রশিক্ষণ কার্যক্রমে একসময় সারাদেশ চষে বেড়িয়েছি এবং জেনেছি প্রশিক্ষণে অংশগ্রহণকারীদের ৯০ ভাগ কখনও কোনো টাকা পান না, তার পত্রিকা থেকে। কিন্তু তাদেরকে যদি বলি টাকা পাচ্ছেন না, ছেড়ে দেন, তখন তারা একটা কথাই বলেন, ছেড়ে দেবো? সাংবাদিকতা করতে তো ভালো লাগে। ছাড়তে পারি না। এটার অর্থই হলো তারা প্যাশনেট। সাংবাদিকতা তাদের ফ্যাশন, প্রফেশন নয়।
আমরা আইনের দাপটে দলিল দস্তাবেজে অন্য/ভিন্ন যাই বলিনা কেন প্রকৃতপক্ষে এটাই বাস্তবতা। এমনকি জাতীয় পর্যায়ের অধিকাংশ সংবাদপত্র তাদের কিছু কর্মীকে মোটামুটি নিয়মিত বেতন দেয়, আরও কিছু পত্রিকা আছে তাদের ঢাকায় কর্মরত বড় অংশ সাংবাদিক তেমন উল্লেখ করার মতো বেতন পাননা যেটি দিয়ে জীবনধারণ করা সম্ভব। সুতরাং তারাও সাংবাদিকতাও ছেড়ে দেন না শুধুমাত্র প্যাশনের কারণে। তারা খুব সাদামাটা চাকরি করলেও এর চাইতে বেশি বেতন পাবেন। ঝালমুড়ি বানিয়ে বেচলেও সংসার ভালো চলতো। তারপরও তাদেরকে যদি প্রশ্ন করা হয় তারা কেন সাংবাদিকতা করেন, তাদের জবাব একটাই, তারা সাংবাদিকতাকে ভালোবাসেন।
প্রান্তে হোক, বা কেন্দ্রে, যারা ফ্যাশন থেকে সাংবাদিকতা করেন, তাদের জীবিকানির্বাহ কীভাবে হয়? এই ব্যাপারে অনুসন্ধান করলে দেখা যাবে তাদের কেউ হয়তো অন্য কোনো চাকুরি করেন, কেউ হয়তো ছোট ব্যবসায়ী, কেউ আইনজীবী, কেউ হয়তো স্কুলের শিক্ষক, কেউ হয়তো প্রাইভেট টিউশনি করেন, কেউ হয়তো সাপ্লায়ার, কেউ হয়তো প্রিনটিংয়ের ব্যবসা করেন। কোনো না কোনোভাবে জীবিকার জন্য তারা অন্য কোনো কাজের সাথে জড়িত।
এখানে যারা প্রফেশনাল হবেন, তারা অবশ্যই পরিপূর্ণ নির্ভরযোগ্য বেতনভাতা পাবেন এবং হবেন পূর্ণকালীন। আর যারা ফ্যাশন থেকে সাংবাদিকতা করবেন তারা হবেন খন্ডকালীন, যারা দিনের বা মাসের কিছু অংশ আয় রোজগারের জন্য অন্য কাজে ব্যয় করবেন এবং অবশিষ্ট অংশ আনন্দের সাথে তার ফ্যাশন, সাংবাদিকতার জন্য ব্যয় করবেন।
সাংবাদিকতা অবশ্যই টিকে থাকবে, এমনকি এখনকার চেয়ে সাংবাদিকতা আরও বিকশিত হবে, সমৃদ্ধ হবে, কিন্তু আমরা এখন যেভাবে সাংবাদিকতাকে চিন্তা করি, সাংবাদিকতা হয়তো একইভাবে ভবিষ্যতে বিরাজ করবে না। সাংবাদিকতাকে আমরা যেভাবে দেখি, যেভাবে সংগঠিত করি তার পরিবর্তন হবে। সাংবাদিকতার সর্বনাশও হবে না। ধ্বংসও হবে না।
সংবাদপত্রের রক্ষণ এবং বিকাশে আরেক ত্রাতার ভূমিকা নেবে প্রযুক্তি। সঙ্গে আর্টিফিশিয়াল ইনটেলিজেন্স। এই দুইয়ের ফলে যারা প্যাশন থেকে কাজ করবেন তারা হয়তো ভার্চুয়ালি অফিস করবেন, শারীরিকভাবে নয়। এমনকি যারা প্রফেশনালি কাজ করবেন তাদের মধ্যেও কেউ কেউ ভার্চুয়ালি অফিস করবেন। বাধ্যতামূলক ভাবে সবসময় দপ্তরে যেতে হবে না। এই সুযোগটা বিশাল সম্ভাবনা তৈরি করছে।
সাংবাদিকতায় এখন বিশেষায়িত দক্ষতার লোকের প্রয়োজন অপ্রতিহতভাবে ক্রমবর্ধমান। একটি সংবাদপত্রের পক্ষে এতো বিশেষায়িত মানুষকে পূর্ণকালীন নিয়োজিত করা বাস্তবসম্মত হবে না। বরং তাদেরকে প্রতিষ্ঠানের সাথে খন্ডকালীন যুক্ত করাই বুদ্ধিমানের কাজ। অন্যদিকে সাধারণ সাংবাদিকদের পূর্ণকালীন রেখে তাদেরকে দিয়ে বিশেষায়িত সাংবাদিকতা করা, যতো দিন যাবে ততো দুরূহ এবং অসম্ভব হয়ে যাবে। কারণ পৃথিবীতে এতো বিশেষ বিশেষ স্পেশালাইজেশন সৃষ্টি হচ্ছে, ব্যবসা-বাণিজ্য, বিজ্ঞান-প্রযুক্তি, আমদানী-রপ্তানি, ডিপ্লোমেসি এর সব বিষয়ে গ্লোবালি যে শতত পরিবর্তনশীল অবস্থা সেখানে এই বিশেষায়িত জ্ঞান সাংবাদিকদের মধ্যে, নিয়মিত এই ফুলটাইম সাংবাদিকদের মধ্যে, নির্ভরযোগ্য বিশেষজ্ঞ লেভেল অর্জন করা কঠিন হবে। যাদের এই রকম বিশেষায়িত বিষয়ে জ্ঞান আছে এবং সাংবাদিকতায় যারা আগ্রহ দেখাবে তাদেরকে যুক্ত করাই হবে যুক্তিসংগত, ভায়াবল এবং অত্যন্ত কোয়ালিটি সিদ্ধান্ত। অবসরপ্রাপ্ত সামরিক/ বেসামরিক আমলা, আইনজীবী, নানান বিষয়ে কনসালটেন্ট, ব্যাংকার, শিক্ষক, গবেষক, বিজ্ঞানীরা হবেন ভবিষ্যৎ সাংবাদিকতার রত্নভান্ডার। প্যাশনেট বিশেষজ্ঞ সাংবাদিক।