রবিবার, ৩১ জানুয়ারী ২০২১
প্রথম পাতা » » লক্ষ্মীপুর-২ আসনের সংসদ পাপুলের উৎথান ও পতন
লক্ষ্মীপুর-২ আসনের সংসদ পাপুলের উৎথান ও পতন
বিশেষ ডেস্ক : লক্ষ্মীপুরের রায়পুরের জন্ম মোহাম্মদ শহীদ ইসলাম পাপুল। তিনি ১৯৮৯ সালে পরিচ্ছন্নতাকর্মী হিসেবে কুয়েতে যান এবং দুই দশকের ভেতরেই একজন স্বপ্রতিষ্ঠিত ধনকুবের হিসেবে আবির্ভূত হন। পরবর্তীতে তিনি বাংলাদেশের একজন সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।
আরব সাগর শুকিয়ে যাবে কিন্তু আমার সম্পদ কখনো শেষ হবে না,” লক্ষীপুরে সাংসদ নির্বাচিত হবার পর এক সংবর্ধনায় এ কথা বলেছিলেন মোহাম্মদ শহিদ ইসলাম ওরফে কাজী পাপুল।
এই একটি বক্তব্যই মানুষকে পাপুলের ব্যক্তিত্বের আভাস দিতে যথেষ্ট। তবে এটি কেবল একটি দিক, মুদ্রার অপর দিকটি অত্যন্ত অন্ধকারাচ্ছন্ন; মানব পাচার, ঘুষ, অর্থ পাচার এবং অন্যায়-দুর্নীতির জালে আষ্টেপৃষ্ঠে ঘেরা।
কুয়েতে যাওয়ার পরপরই মানব পাচারকারী চক্র চালানোর অভিযোগে আসে তার বিরুদ্ধে। তিনি কুয়েতি কর্মকর্তাদের ঘুষ দিয়ে গ্রেপ্তার হন, কুয়েতের আদালতে দোষী সাব্যস্ত হন এবং সবশেষে কৃতকর্মের জন্য চার বছরের কারাদণ্ড প্রাপ্ত হন।
এরমধ্যে, বাংলাদেশেও তাকে পরিবারের সদস্যবৃন্দসহ মানব পাচার, অর্থ পাচার এবং অবৈধভাবে সম্পদ জমা করার অভিযোগে তিনটি মামলায় অভিযুক্ত করা হয়েছে।
এছাড়াও হাইকোর্ট আরও দুটি মামলায় রুল জারির প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছে- নির্বাচন কমিশনে ভুয়া সার্টিফিকেট জমা দেয়ার জন্য এবং তার স্ত্রী ও কন্যার বিরুদ্ধে নকল অভিযোগপত্রের মাধ্যমে জামিন আবেদনের জন্য।
যেভাবে উত্থান পাপুলের
লক্ষীপুরে জন্মগ্রহণ করা পাপুল ১৯৮৯ সালে ‘ওয়ার্কিং ভিসা’র অধীনে কুয়েত যান। এরপরে ইরাকে গেলেও সেখানে উপসাগরীয় যুদ্ধ শুরু হয়ে যাওয়ায় দেশে ফিরে এসে আবার কুয়েত যান। সেটি ১৯৯২ সালের কথা।
পাপুলের উত্থান একেবারে কাছ থেকে দেখেছেন এমন একজন কুয়েতপ্রবাসী বাংলাদেশি ব্যবসায়ী মিজান আল রহমান ভোরের বানীকে জানান, ২০০০ সাল পর্যন্ত কুয়েতের মারাফি কুয়েতিয়া গ্রুপের একজন মধ্যম মানের কর্মচারী ছিলেন এই পাপুল।
মধ্যপ্রাচ্যে বাংলাদেশ দূতাবাসের কর্মীদের সাথে পাপুলের ঘনিষ্ঠতা ছিল বলে মিজান উল্লেখ করেন। তিনি আরও বলেন, পাপুলের অনৈতিক কার্যকলাপের শুরুটা এই দূতাবাস থেকেই।
“দূতাবাসের সাথে ঘনিষ্ঠতার সুযোগ নিয়ে ২০০৪-২০০৫ সালের দিকে পাপুল মারাফি গ্রুপের নেপালি ম্যানেজারের পদচ্যুতির ব্যবস্থা করেন। এরপর নিজেই কোম্পানির উচ্চ পদটিতে আসীন হন।”
২০০৮ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে কুয়েতে বাংলাদেশ দূতাবাস পাপুলকে মানব পাচারের অভিযোগে কালো তালিকাভুক্ত করে।
সে সময়, পাপুল জনপ্রতি ৭-৮ লাখ টাকার বিনিময়ে কিছু বাংলাদেশি শ্রমিককে কুয়েতে নিয়ে এসে তাদের জোরপূর্বক যুদ্ধবিধস্ত ইরাকে প্রেরণ করেন।
আওয়ামী লীগের ‘কুয়েত শাখার’র সাধারণ সম্পাদক আতাউল গণি জানান, কালো তালিকাভুক্ত হওয়া সত্ত্বেও পাপুল কুয়েতে বাংলাদেশি প্রবাসী নাগরিকদের কাছে শিশুদের জন্য একটি স্কুল প্রতিষ্ঠায় মোটা অংকের অনুদানের প্রস্তাবের মাধ্যমে আলোচনায় চলে আসেন।
“অনুদান আর স্কুল প্রতিষ্ঠার অজুহাতে সে আবারও দূতাবাসে প্রবেশের সুযোগ পায়। ভাল বেতনে চাকরির আশা দিয়ে নতুন করে সে বাংলাদেশ থেকে লোক নিয়ে আসা শুরু করে।
“এমনকি ২০১৭ সালে দূতাবাসের কর্মকর্তাদের পরিবারের লোকজনও মারাফি গ্রুপে আকর্ষণীয় বেতনে চাকরিতে যোগ দেয়। ২০২০ সাল পর্যন্ত এরা পাপুলের সেবায় নিয়োজিত ছিল। এ ঘটনাগুলো কুয়েতের শ্রম বাজারে পাপুলের অবস্থান শক্ত করে তুলে”, বলেন আতাউল গণি।
কুয়েতে পাপুলের পসার ও পরিচিতি থাকলেও দেশে তাকে ২০১৬ এর আগে কেউ চিনত না।
রাজনীতির ময়দানে কোনরূপ পূর্ব অভিজ্ঞতা না থাকা সত্ত্বেও ২০১৮ সালের নির্বাচনে লক্ষ্মীপুর-২ আসন থেকে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসাবে এমপি নির্বাচিত হয়ে তিনি আলোচনায় চলে আসেন। লক্ষীপুরবাসীর ধারণা, এটির পেছনেও রয়েছে তার কালো টাকার প্রভাব।
পাপুলের নির্বাচিত এলাকার অনেকে এটাও ভেবে থাকেন যে, পাপুল নির্বাচনে তার জাতীয় পার্টির প্রতিপক্ষকে ঘুষ দিয়ে চুপ করিয়ে রাখেন; প্রতিপক্ষের প্রার্থী পাপুলকে বরং বিভিন্ন সময় ‘সমর্থন’ দিয়ে গেছেন।
নিজে সাংসদ হিসেবে নির্বাচিত হয়েই পাপুল ক্ষান্ত থাকেননি, সংরক্ষিত আসনের কোটায় তার স্ত্রীকেও তিনি এমপি করে নেন।
উত্থানের হাত ধরেই আসে পতন
২০২০ সালের ২২শে ফেব্রুয়ারি কুয়েতের আরবি দৈনিক ‘আল কাবাস’ বাংলাদেশী এ সাংসদের মানব পাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবেদন প্রকাশ করে। পর্যায়ক্রমে কুয়েত এবং বাংলাদেশের বিভিন্ন পত্রিকা পাপুলের বিরুদ্ধে প্রতিবেদন প্রকাশ করতে থাকে।
মহামারীর জন্য পাপুল সে সময় দেশেই অবস্থান করছিলেন। মে মাসে তিনি এসব নিষ্পত্তি করতে কুয়েতের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেন।
জুনের ৬ তারিখে, কুয়েতের ক্রিমিনাল ইনভেস্টিগেশন ডিপার্টমেন্ট (সিআইডি) কর্তৃক নিজ বাসা থেকে গ্রেপ্তার করা হয় তাকে। তার বিরুদ্ধে মানব পাচার, অর্থ পাচার এবং কুয়েতের কর্মকর্তাদের ঘুষ দেওয়ার অভিযোগ আনা হয়।
পাচারের কেলেংকারি আস্তে আস্তে ফাঁস হতে থাকায় বাংলাদেশী সহযোগীসহ পাপুল এবং অভিযুক্ত কিছু কুয়েতি কর্মকর্তাকে কারাগারে আটক করা হয়। কর্তৃপক্ষ কুয়েতে মারাফি গ্রুপের কার্যক্রমও বন্ধ করে দেয়।
কুয়েতের পর বাংলাদেশ পর্ব শুরু হয়। ৭ জুলাই, সিআইডি ঢাকায় পাপুলের বিরুদ্ধে মানব পাচারের অভিযোগ আনে। ২০২০ এর নভেম্বর ও ডিসেম্বর মাসে পাপুল, পাপুলের পরিবার এবং সহকর্মীদের বিরুদ্ধে সিআইডি এবং দুর্নীতি দমন কমিশন কর্তৃক আরও দুটি মামলা দায়ের করা হয়।
সিআইডিতে পুলিশের সহকারী সুপারিনটেন্ডেন্ট আল-আমিন হোসেন জানান, মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে উচ্চ বেতনে চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে পাপুলের সহযোগীরা প্রত্যেক অভিবাসীর কাছ থেকে ৫-৭ লাখ টাকা নিত।
সিআইডি জানায়, পাপুল, তার পরিবার এবং সহযোগীরা মিলে বাংলাদেশ থেকে ৩৮.২২ কোটি টাকা পাচার করেছে বলে তাদের কাছে স্পষ্ট প্রমাণ রয়েছে। ২০১৬ থেকে ২০২০ এর ভেতরে পাচারকৃত অর্থের পরিমাণ ৩৫৫ কোটি টাকার কাছাকাছি হতে পারে বলে সিআইডি’র ধারণা ।
আল আমিন হোসেন জানান, তারা এখন টাকার পুরো পরিমাণটি সনাক্তের চেষ্টা চালাচ্ছেন।
ঢাকা কোর্ট পাপুলের পরিবারের ৫৭০টি ব্যাংক একাউন্ট জব্দ করেছে।
এইচএসসির আগেই পাপুলের গ্র্যাজুয়েশন!
এই আইনপ্রণেতা নির্বাচন কমিশনে জমা দেওয়া হলফনামায় তার জন্ম তারিখ উল্লেখ করেননি।জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় সাংবাদিকদের পাপুল যে তথ্য প্রদান করেছেন সে অনুযায়ী তিনি ১৯৬৩ সালে জন্মগ্রহণ করেন।
সে হিসেবে, ১৯৯২ সালে পাপুল যখন উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা দেন তখন তার বয়স হওয়ার কথা ২৯! নির্বাচন কমিশনের হলফনামা বলছে, তিনি অর্থনীতিতে স্নাতক।
কিন্তু হাইকোর্টের আইনজীবি সালাহউদ্দিন রিগান বলেন, পাপুলের এই স্নাতক সার্টিফিকেটটি জাল।
এই আইনজীবি বলেন, “ইসির হলফনামা মোতাবেক, তিনি ১৯৮৭ সালে সিয়েরা লিওনের মিলটন মারগাই কলেজ অফ এডুকেশন এন্ড টেকনোলজির স্নাতক ব্যাচের শিক্ষার্থী ছিলেন। অথচ এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটির অর্থনীতি কোর্সটিই নেই।”
“আর যদি সেখানে অর্থনীতি বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত থেকেও থাকত, তাহলেও বলতে হয় তার প্রদানকৃত বিএসএসের সার্টিফিকেটটি ভুয়া। কারণ হলফনামা অনুযায়ী তিনি উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেন ১৯৯২ সালে, তার স্নাতক পাসেরও পর!”
এসব তথ্যের সত্যতা যাচাইয়ে রিগান এই সংসদ সদস্যকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে হাইকোর্টে একটি রিট আবেদন করেছেন।
বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সির (বায়রা) মহাসচিব শামীম আহমেদ চৌধুরী নোমান বলেন, পাপুল এ এজেন্সির সদস্য নয় কারণ তার নিয়োগ এজেন্সির কোন লাইসেন্সই নেই।
“তার স্ত্রী আমাদের কাছে কয়েক মাস আগে একটি অনাপত্তি সার্টিফিকেটের জন্য আবেদন জানায়। কিন্তু আমরা এ কারণে তাকেও মানা করে দেই।”
“এমনকি তার ভাই যিনি একটি নিয়োগ সংস্থা পরিচালনা করেন, তার সম্পর্কেও আমাদের কাছে কোন তথ্য নেই।”
নাম প্রকাশ না করার শর্তে কুয়েতে লোক প্রেরণ করেন এমন আরেকজন নিয়োগকারী সংস্থার কর্মকর্তা জানান, “ব্যবসায়ী হিসাবেই পাপুলকে আমি কুয়েতে কয়েক বছর ধরে চিনি। তার নিজের কোনও এজেন্সি নেই তবে তার ছোট ভাইয়ের একটি আছে। পাপুল তার ভাইয়ের এজেন্সির মাধ্যমে তার সংস্থায় বাংলাদেশিদের নিয়োগ দিতেন” ।
অপর একটি নিয়োগকারী সংস্থার মালিক মোঃ শাহাদাত হোসেন বলেছেন, “কুয়েতে গ্রেপ্তারের আগ পর্যন্ত আমরা তাকে চিনতামই না।”
তথ্য - দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড