জমিদারদের লালসার শিকার হতো ঘেটুপুত্ররা!
আষাঢ়-শ্রাবণ মাসে হাওর অঞ্চলে চারদিক পানিতে থৈ থৈ করে। সেসময় তেমন কোনো কাজও থাকে না মানুষের। বেশিরভাগ অলস সময়ই কাটায় বাংলার মানুষ। এখন আধুনিক প্রযুক্তির আশির্বাদে সময় কাটানো কোনো ব্যাপারই না। তবে জমিদারদের আমলে তাদের জন্য এই সময়টা কঠিনই ছিল। তাই বর্ষাকালে যখন নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়, মাঠ-ঘাট-ফসলের জমি পানিতে একাকার হয়ে যায়। তখন ঐসব এলাকার জমিদাররা এক ধরণের বিশেষ নৃত্য-গানের আয়োজন করতেন।
বিস্ময়ের ব্যাপার হলো সেখানে কোনো মেয়ে বা নারী নাচ গান করতো না! বরং একটি ছেলেকে মেয়ে সাজিয়ে রাজার সামনে তাকে নাচানো হতো। এই ব্যাপারটার সঙ্গে পাঠকদের অনেকেই হয়তো কিছুটা পরিচিত। কেননা শ্রদ্ধেয় লেখক হুমায়ূন আহমেদ এর শেষ ছবি ঘেটুপুত্র কমলা দেখেননি এমন কাউকে হয়তো খুঁজে পাওয়া যাবে না। হ্যাঁ, লেখকের সেই চরিত্রের আদ্যোপান্তই আজ জানাবো ডেইলি বাংলাদেশের পাঠকদের।
কেউ কেউ বলেন ৪০০ বছর আগে অবিভক্ত বাংলার ময়মনসিংহ, কুমিল্লা, সিলেট প্রভৃতি অঞ্চলে এক ধরনের লোকগানের প্রচলন হয়েছিল, তার নাম ঘেটুগান। এই গানের দলে নদীর বুকে নৌকো নিয়ে ভাসতে ভাসতে ঘাটে ঘাটে নেমে বায়না নিয়ে নাচ দেখাত ও গান শোনাত বলেই এর নাম ঘেটুগান। ঘাট থেকে ঘেটু। ঘেটুগান আসলে কৃষ্ণের বিরহে রাধার গান। এই গান নেচে নেচে রাধা সেজে পরিবেশন করত কিশোরেরা। তাদের পরনে থাকত রাধার পোশাক, অলঙ্কার, পায়ে আলতা, চোখে কাজল। এ-সময় গড়ে উঠেছিল ঘেটুগানের অনেকগুলো দল।
বাংলার জমিদাদের লালসার স্বীকার হতো হত দরিদ্র পরিবারের ছেলে শিশুরা
মেয়ের সাজে এসব ছেলেদেরকেই বলা হয় ঘেটুপুত্র। আরো আশ্চর্য্যের বিষয় হলো যে এই ঘেটুপুত্রদের কাজ শুধু নাচ-গানেই সীমাবদ্ধ থাকতো না, জমিদারের বিকৃত যৌন বাসনা পূরণ করার জন্য তাদেরকে জমিদারের শয্যাসঙ্গীও হতে হতো! তবে মজার ব্যাপার হলো এসব ঘেটুপুত্রদের কিন্তু সমকামীদের মতো কিংবা হিজড়াদের মতো কোনো জেনেটিক ত্রুটি ছিল। এমনটা কিন্তু না। তারা সম্পূর্ন সুস্থ ছিল। টাকার বিনিময়ে কতিপয় বিকৃত যৌনরুচির লোকদের মনোরঞ্জন করার জন্যই এরা ঘেটুপুত্র সাজতো।
ঘেটুপুত্র কমলা ছবিতে কমলা নামের এক দরিদ্র ঘেটুপুত্রের কাহিনী দেখা যায়। মূলত অভাবী ঘরের দেখতে সুন্দর কিশোরদেরই এসব দলে নেয়া হত, তালিম দেয়া হত নাচ গানের। সবসময় তাদের সাজিয়ে রাখা হত মেয়েদের সাজে। লোকে এদের বলত ঘেটুপুত্র। সেকালের অভিজাতশ্রেণির মানুষেরা বাড়িতে ঘেটুগানের আসর বসাতেন। রাধারূপী ঘেটুপুত্রকে মনে ধরলে, তাকে কিছুদিনের জন্য বাড়িতে রেখে দিতেন। বিশেষত পুরো বর্ষার সময়টা।
অনেকের মতে প্রায় ১৫০ বছর আগে, ব্রিটিশ আমলে বর্তমান বাংলাদেশের হবিগঞ্জ জেলার জলসুখা গ্রামের এক বৈষ্ণব আখড়ায় ঘেটুগান নামে নতুন গ্রামীন সঙ্গীতধারা সৃষ্টি হয়েছিল। নতুন সেই সঙ্গীত ধারাতে মেয়েদের পোশাক পরে কিছু সুদর্শন সুন্দর মুখের কিশোরদের নাচগান করার রীতি চালু হয়। এই কিশোরদের আঞ্চলিক ভাষাতে ঘেটু নামে ডাকা হতো। ঘেটু নামের নব এই সঙ্গীত ধারাতে গান প্রচলিত সুরে কীর্তন করা হলেও উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের প্রভাব বেশ লক্ষণীয় ছিল। গ্রাম্য অঞ্চলের অতি জনপ্রিয় নতুন সঙ্গীতরীতিতে নারী বেশধারী কিশোরদের উপস্থিতির কারণেই এর মধ্যে অশ্লীলতা ঢুকে পড়ে।
সমকামী বিত্তবানরা বিশেষ করে জোতদার প্রমুখ এইসব কিশোরকে যৌনসঙ্গী হিসেবে পাবার জন্যে লালায়িত হতে শুরু করে। একসময় সামাজিকভাবে বিষয়টা স্বীকৃতি পেয়ে যায়। হাওর অঞ্চলের জমিদার ও বিত্তবান শৌখিন মানুষরা বর্ষাকালে জলবন্দি সময়টায় কিছুদিনের জন্যে হলেও ঘেটুপুত্রদের নিজের কাছে রাখবেন এই বিষয়টা স্বাভাবিকভাবে বিবেচিত হতে থাকে। এই সময়টায় তাদের নিয়মিত শয্যাসঙ্গী হতে হতো সেই অভিজাত মানুষটির। এক সময় এটাই প্রথা হয়ে দাঁড়ায়। তখন এই প্রথার বিপক্ষে সমাজ কোনো প্রশ্ন তোলেনি কিংবা তুলবার সাহস করেনি। সমকামী বিত্তবানদের স্ত্রীরা ঘেটুপুত্রদের দেখতেন সতীনের চোখে। এমনকি সতীন বলে ডাকতেও শুরু করেন। ষাট-সত্তর বছর আগেও এই প্রথার বেশ চল ছিল। প্রথার সঙ্গে এখন অবশ্য লুপ্ত হয়েছে এ গানের ধারাও।
আচ্ছা এবার চলুন ঘুরে আসি মোঘল সাম্রাজ্য থেকে। সময়টা,সম্রাট হুমায়ূন যখন শের খাঁর বিরুদ্ধে যুদ্ধ যাত্রা করছিলেন তখনকার কথা। সম্রাট বাংলা মুলুক কখনো দেখেননি। শের খাঁকে পরাস্ত করে তিনি বাংলা মুলুকে কয়েকদিন বাস করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তিনি লোকমুখে শুনেছেন, বাংলা মুলুকের হিজড়ারা নাকি নৃত্যগীতে বিশেষ পারদর্শী! তাদের নৃত্যগীত সাধারণ নৃত্যগীতের চেয়ে একেবারে আলাদা। কতটা আলাদা তা সম্রাটেরও দেখার ইচ্ছা। সম্রাটের ভাই আসকারি মির্জা বঙ্গ বিজয়ের পর উপহার হিসেবে সম্রাটের কাছে কয়েকজন হিজড়া চেয়েছিলেন!সম্রাট হুমায়ূনের পতনের পর হুমায়ূনের ভাই কামরান মীর্জা যেন তাকে ধরিয়ে দেয় সেজন্য শের শাহ্ কামরানকে কিছু উপহার পাঠিয়েছিলেন। এসব উপহারের মধ্যে দুজন হিজড়াও ছিল। বঙ্গদেশের হিজড়াদের মোঘল হেরেমে কদর ছিল। রাজপুরুষরা যৌন কদর্যতামুক্ত ছিলেন না। নিজেদের বিকৃত যৌন লালসা পূরণ করার জন্য রাজা-বাদশা থেকে জমিদাররা। সব আমলেই হিজড়া এবং ঘেটুপুত্র নিয়ে নাচ গানের নামে সমকামিতায় লিপ্ত ছিলেন। তবে বেশির ভাগ ঘেটুপুত্রদের শেষ পরিণতি হত হুমায়ূন আহমেদের ঘেটুপুত্র কমলা ছবির কমলার মতো করুণ।
বাংলাদেশের এই বিখ্যাত সাহিত্যিক ও চলচ্চিত্র পরিচালক হুমায়ুন আহমেদের শেষ পরিচালিত ছবি ঘেটুপুত্র কমলা। ছবিটিতে ঘেটুগানের সূত্র ধরে বাঙালির সমকামিতার ইতিহাসের এই অধ্যায়টি তিনি তুলে ধরেছেন। এটি ছাড়াও তার আরো কিছু লেখায় তিনি নানাভাবে এই ঘেটুপুত্রদের প্রসঙ্গ তুলে ধরেছেন। জমিদাররা ছাড়াও সেসময় কেউ একটু ধনী হলেই ঘেটুপুত্র রাখতেন। যাই হোক, বাংলার ইতিহাসের বিলাসিতার নামে এর বর্বরতার উদাহরণ ঘেটুপুত্র। এখন অবশ্য এই প্রথার প্রচলন নেই একেবারেই। নেই সেই গানের আসরেরও।