সামাজিক মাধ্যম যেন অসামাজিক না বানায়
নাসরিন আক্তার
আমাদের বহুল পরিচিত এবং ব্যবহৃত শব্দযুগল সামাজিক মাধ্যম। যারা একটু লিখতে পড়তে পারে এবং যাদের ইন্টানেট সংযোগ নেবার সক্ষমতা আছে তাদের প্রায় সবাই সামাজিক মাধ্যম ব্যবহার করে। সামাজিক মাধ্যম বলতে ইন্টারনেট ভিত্তিক কিছু ওয়েব এবং এপ্লিকেশনকে বোঝায়, যেখানে মানুষ একে অপরের সাথে যোগাযোগ করা থেকে শুরু করে তাদের চিন্তা-ভাবনা এবং তথ্য শেয়ার করতে পারে। সামাজিক মাধ্যম শব্দ দুটোর মধ্যেই এর অর্থ নিহিত আছে। মানুষ সামাজিক জীব, প্রতিনিয়ত সে অন্যদের সাথে কানেক্টেড থাকতে চায়, কমিউনিটিতে বিলং করতে চায়। আর মাধ্যম হল তাই যেটা মানুষ ব্যবহার করে সবার সাথে কানেক্টেড থাকতে, মিথস্ক্রিয়া করতে। তার মানে সামাজিক মাধ্যম হচ্ছে সামাজিক মিথস্ক্রিয়ার জন্য ব্যবহৃত মাধ্যম। যেমন ফেসবুক, টুইটার, ইমেইল, ইউটিউব, হোয়াটস্অ্যাপ, পিন্টারেস্ট, ইন্সটাগ্রাম ইত্যাদি।
আমাদের দৈনন্দিন জীবনযাপনের সাথে এই মাধ্যমগুলো এমনভাবে জড়িয়ে গেছে, যেন এগুলো আমাদের অস্তিত্বেরই অংশ, যেন এই মাধ্যমেই আমাদের বসবাস! মানুষে মানুষে দূরত্ব ঘুচিয়ে পুরো পৃথিবীকে এনে দিয়েছে আমাদের হাতের মুঠোয়, গড়ে দিয়েছে দেশ, জাতি, ধর্ম, বর্ণ, কালভেদে কমন প্ল্যাটফর্ম। প্রতিনিয়ত পাওয়া যাচ্ছে হাজারো বিষয়ে দুনিয়ার আনাচে কানাচে ছড়িয়ে থাকা নানা তথ্য। বন্ধুত্ব ও সম্পর্ক তৈরি এবং রক্ষা হয়েছে সহজ থেকে সহজতর। পাড়া-মহল্লা আর চায়ের দোকানের মত তর্ক-বিতর্ক চলে এখানেও, অনেকে চালাচ্ছেন অনলাইন ব্যবসাও। ফলে বোঝাই যাচ্ছে সামাজিক মাধ্যমের গুরুত্ব আমাদের জীবনে কতটা গভীর।
কিন্তু এত এত ইতিবাচক দিক থাকা সত্ত্বেও এর কিছু নেতিবাচক প্রভাব আমাদের জীবনে রয়েছে, যা দিনকে দিন ভয়াবহ রূপ নিচ্ছে। আমরা এখন মানবীয় মুখোমুখি যোগাযোগের চেয়ে এসব মিডিয়ায় ভার্চুয়াল যোগাযোগ বেশি করছি, এতে করে মানুষের শারীরিক এবং আবেগীয় অনুভূতির যে স্বাভাবিক প্রকাশ তা ব্যাহত হচ্ছে। আগে আমরা একে অন্যের উপর যে পরম বিশ্বাস আর স্বস্তির সাথে নির্ভর করতাম, তা এখন লোপ পাচ্ছে। জীবন থেকে প্রচুর সময় কেড়ে নিচ্ছে, আমাদের আত্ম-নিয়ন্ত্রণ এবং স্বাধীন চিন্তার ক্ষমতাকে খর্ব করছে। প্রায়ইকে কে কী লিখলো বা কোন গ্রুপে কী পোস্ট হল তা নিয়ে স্রোতের সাথে গা-ভাসিয়ে হাসাহাসি করছি, মজা নিচ্ছি বিষয়টার ফলাফল কী হতে পারে তা মূল্যায়ন না করেই।
সমাজবিজ্ঞানীদের ভাষায় সামাজিক মাধ্যম মানুষকে বরং অসামাজিক বানাচ্ছে। সামাজিক মাধ্যম সমাজে মানুষের উপর কী ধরণের নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে তা নিয়ে নানা সময়ে গবেষণা হয়েছে। এসব গবেষণায় দেখা গেছে, সামাজিক মাধ্যম আমাদের ভেতরে বিষন্নতা তৈরি করে। বারবার নোটিফিকেশন চেক করা, মেসেজ এসেছে কিনা সদা সতর্ক থাকা, ফেসবুকে ঘন ঘন ছবি দেয়া, স্ট্যাটাস দেয়া এবং প্রতিনিয়ত অন্যদের মনোযোগ এবং প্রতিক্রিয়া আকাঙ্ক্ষা করা- এগুলো প্রচণ্ডভাবে মানসিক চাপ বাড়ায়। তাছাড়া সামাজিক মাধ্যমে আমরা জীবনের খণ্ডিত একটা অংশ শেয়ার করি। শুধুই আনন্দের মুহূর্তগুলো সবার জন্য উন্মুক্ত করি। এতে অন্যদের কাছে ভুল বার্তা যায়। আপনি আপনার জীবনে অসুখি থাকলেও অন্যরা ভাববে আপনি সুখি এবং এ কারণে আপনি আসলে কেমন আছেন তা হয়তো কেউ খোঁজ নিবে না। আবার আপনিও হয়তো অন্য কারো ওয়াল দেখে একইরকম ভাবছেন। শুধু তাই নয়, প্রতিনিয়ত চলছে একে অপরের সাথে তুলনা এবং বাড়ছে হতাশা আর বিষণ্ণতা। এসব মাধ্যম দূরকে কাছে এনেছে বটে কিন্তু পরিবার, বন্ধুবান্ধব, প্রতিবেশীসহ কাছের মানুষ যারা আছে তাদেরকে সড়িয়ে দিচ্ছে দূরে। ফলে বাড়ছে কৃত্তিম অন্তরঙ্গতা এবং একাকিত্ব।
আরেকটি আতঙ্কের যে বিষয় তা হল সামাজিক মাধ্যমকে ব্যবহার করে অপরাধ কার্যক্রম চালানো। সাইবার বুলিং চরম আকারে বেড়ে গেছে। অন্যের গোপন কথোপকথোন, ছবি বা ভিডিও প্রকাশ করে দেয়া বা বাজে উদ্দেশ্য নিয়ে সেগুলো এডিট করে মাধ্যমগুলোতে ছেড়ে দেয়া, হ্যারাজ করা বা এ নিয়ে হুমকি ধামকি দেয়া, আক্রমণাত্মক ভাষায় গালিগালাজ করা, ট্রল করা, কারো নামে গুজব ছড়ানো বা ভূয়া আইডি খুলে তাকে বাজেভাবে উপস্থাপন করা- এগুলো সবই সাইবার অপরাধ যা প্রতিনিয়ত ঘটছে এখন। নারীরা এর শিকার বেশি হচ্ছেন। আবার এই মাধ্যমগুলো ব্যবহার করে চলছে বিভিন্ন সন্ত্রাসবাদী গোষ্ঠীগুলোর অপতৎপরতা। অনুচরবৃত্তি চালানো, ফান্ড কালেক্ট করা, নতুন মেম্বার রিক্রুট করা, প্রপাগান্ডা ছড়ানো সবই এখন এই মাধ্যমগুলোর জন্য সহজ হয়ে গেছে অপরাধ গোষ্ঠীর কাছে। চলছে হিউম্যান ট্রাফিকিং এবং ড্রাগ ডিলিংও।
যুক্তরাষ্টের ন্যাশনাল হিউম্যান ট্রাফিকিং হটলাইনের রেকর্ডমতে ২০১৫ থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে দেশটিতে প্রায় এক হাজারটি সেক্স ট্রাফিকিং এর ঘটনা রিপোর্ট হয় যেগুলোর অধিকাংশই ফেসবুকের মাধমে সংঘটিত হয়েছে। শিকারিরা ছদ্দবেশে সামাজিক মাধ্যমগুলোতে বিচরণ করে এবং চাকরি, প্রেম বা বিভিন্ন ধরণের প্রতারণামূলক ফাঁদ পেতে শিকার করে বেড়ায়।
ইদানিংকালে আরেকটি বিষয় লক্ষ্য করা যাচ্ছে যে অনেকেই ফেসবুক লাইভে এসে নানা রকম অপরাধ করছে। এই করোনার সময়েই দেখলাম বাংলাদেশের এক ব্যক্তি ফেসবুক লাইভে এসে নিজ স্ত্রীকে কুপিয়ে হত্যা করেছেন। আরেকটি ঘটনায় দেখা গেলো গণধর্ষণের পর ফেসবুক লাইভে এসে চার ধর্ষককে উল্লাস করতে। নির্যাতন করা হচ্ছে, এরকম ভিডিও প্রায়ই এখন ফেসবুকসহ নানা মাধ্যমে দেখা যায়। যুক্তরাষ্ট্রে প্রায়ই ফেসবুক লাইভে ম্যাস শুটিংয়ের ঘটনা ঘটছে। এ ধরনের ঘটনাগুলোর কারনকে শুধুই মনোবিকৃতি হিসেবে ধরে নিলে ভুল হবে। অপরাধীদের মনোজগতে সামাজিক মাধ্যমগুলো প্রভাবক হিসেবে কাজ করছে কিনা তা নিয়ে দরকার আরো গবেষণা।
সামাজিক মাধ্যমগুলোর ট্রল এবং মিম কালচার বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে, মানুষ সব বিষয়কেই হাল্কাভাবে নিচ্ছে। আর কোনো একটা বিষয়ে ট্রল শুরু হলে তাতে সবাই গা ভাসায়। এভাবে অনেক সিরিয়াস বিষয় হালকা হয়ে যাচ্ছে। যেমন উদাহরণস্বরুপ বলা যায় ওয়াজ মাহফিলের বক্তব্য নিয়ে ট্রল ও মিম হচ্ছে প্রচুর। এসব বক্তব্যের বেশিরভাগই ভয়াবহ রকমের সাম্প্রদায়িক এবং নারীবিদ্বেষী। এগুলো নিয়ে ট্রল, মিম বানিয়ে হাসাহাসি করে উড়িয়ে দিলে ব্যাপারগুলোর হালকা হয়ে যায়, এগুলো সমাজের জন্য যে কতটা ক্ষতিকর প্রভাব রাখে তা নিয়ে তখন আর মানুষ সিরিয়াসলি ভাবে না।
মনোবিজ্ঞানীরা বলছেন, ফেসবুকসহ অন্যান্য সামাজিক মাধ্যমগুলো আমাদের মধ্যে আত্ম-প্রেম প্রকট আকারে বাড়িয়ে দিচ্ছে। বারবার প্রোফাইল ফটো পরিবর্তন, প্রচুর সেলফি পোস্ট দেয়া, একটু পর পর নিজের কাজকর্ম, গতিবিধি, চিন্তা, অনুভূতি সম্পর্কে আপডেট দেয়া এবং সেগুলোতে অন্যদের বেশি বেশি লাইক, কমেন্ট, শেয়ার প্রত্যাশা করা, নিজেকে বেশি গুরুত্বপূর্ণ মনে করা, নিজের কোনো অর্জনকে ফলাও করে প্রচার করা, সকল বিষয়ে নিজেকে বিশেষজ্ঞ হিসেবে উপস্থাপনের চেষ্টা, প্রতিনিয়ত অন্যদের মনোযোগ নেবার চেষ্টা, কারো সাথে মতের পার্থক্য হলে আক্রমণাত্মক হয়ে যাওয়া এ সবই আত্মপ্রেমের লক্ষণ।
বিবিসি বাংলার এক রিপোর্টে ‘ডিচ দ্য লেবেল’ নামের সংস্থার গবেষণা ফলাফল তুলে ধরে। সেখানকার গবেষণা জরিপে অংশ নেয় তরুণরা, যাদের ৪০ শতাংশই জানায় তাদের সেলফিতে লাইক না দিলে খারাপ বোধ করে। ৩৫ শতাংশ জানায় তাদের আত্ম-প্রত্যয় নির্ভর করে কতজন তাদের ফলো করছে তার উপর। ফলে বোঝাই যাচ্ছে সামাজিক মাধ্যম আমাদেরকে নার্সিসিস্ট বানিয়ে তুলছে।
প্রতিদিনের একটা বৃহত্তর অংশ এই সামাজিক মাধ্যমে কাটানোর ফলে মানুষ এখন কাছের পরিজনদের সময় কম দিচ্ছে, তাদের খোঁজ খবরও রাখছে না ক্ষেত্র বিশেষে। আবার যে অভ্যাসগুলো আগে ছিলো সেগুলো এখন হারিয়ে যাচ্ছে, যেমন বই পড়া, ভালো সিনেমা দেখা, বাগান করা, নিয়মিত স্বাস্থ্যচর্চা করা। একদিকে তরুণ প্রজন্মের মধ্যে বাড়ছে আত্মপ্রেম, আবার একইসঙ্গে তাদের চিন্তা-চেতনার পরিধি হালকা হয়ে আসছে। সমাজ সংস্কৃতি সম্পর্কে পড়াশোনা না থাকার ফলে, গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে তাদের আগ্রহও কমে যাচ্ছে। অথচ এই এরাই আবার নিজেদের সব বিষযে নিজেদের বিশেষজ্ঞ মনে করছে! বিষয়টি চরম উদ্বেগের।
এই কথাগুলো আমরা সবাই জানি। তারপরও নতুন করে মনে করিয়ে দেবার চেষ্টা। কারণ লকডাউনের বন্দি সময়ে আমরা সবাই সময় কাটাতে হোক, পরিজন, বন্ধু-বান্ধব বা চেনাজানা মানুষগুলোর খোঁজ খবর নিতে হোক বা অন্য যে কোন কারণে আমরা সামাজিক মাধ্যম ব্যবহার বাড়িয়ে দিয়েছি। ফলে ব্যবহারের সময়ে আমরা যেন একটু সতর্ক থাকি, যেন সীমাকে অতিক্রম করে না যাই। আর আমাদের ব্যস্ত জীবনের এই বিরতিকে একটু আত্মোন্নতির জন্যও ব্যবহার করতে পারি। যেমন ঘরে বসেই ফ্রি অনলাইন কোর্স করে নিজের দক্ষতা বাড়াতে পারি। ভালো কয়েকটি বই পড়ে ফেলতে পারি, ভালো ভালো কিছু সিনেমা দেখে নিতে পারি যেগুলো সমাজ সংস্কৃতি বা বৈশ্বিক পরিপ্রেক্ষিত সম্পর্কে আমাদের জ্ঞানকে আরও সমৃদ্ধ করবে। শেষ কথা হল সামাজিক মাধ্যম ব্যবহার করবো ঠিক আছে কিন্তু পরিমিতিবোধ বজায় রেখে এবং খেয়াল রাখি যেনো আমরা অসামাজিক জীবে পরিনত না হই।
লেখক: নাসরিন আক্তার
প্রভাষক, জার্নালিজম কমিউনিকেশন অ্যান্ড মিডিয়া স্টাডিজ বিভাগ
স্টেট ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ