জেগে আছি, তুমি উত্তরের মাটিতে ঘুমাও…
রফিকুল ইসলাম মন্টু :
তাঁর চাই সরেজমিন তথ্য। মানুষের কাছে গিয়ে মানুষের খবর। একদম ছুঁয়ে দেখা— যা বানানো নয়, সাজানো নয়। দেখার চোখ দিয়ে নিজের চোখে দেখার বিষদ বিবরণ। মানুষের দুঃখ-বেদনা, আবার রাগ-ক্ষোভ, কিংবা চাল-ডাল-গম চুরি, পুকুর চুরির খবর পর্যন্ত। বাদ যায়নি কোনোটা। ওষুধ চুরির খবর সংগ্রহের জন্য রোগী সেজে হাসপাতালে ভর্তি তাকেই মানায়— যিনি চান তরতাজা তথ্য, খবরের পেছনের আসল খবরটা। তাঁর বলপেনের ডগায় উঠে আসে ভূখানাঙ্গা মানুষের দুরাবস্থা-দুর্দিনের সংবাদ। খাদ্যাভাব, পুষ্টির অভাব, মঙ্গা, এগিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন— নানান কিছু তাঁর খবরের বিষয়। হ্যাঁ, মোনাজাতউদ্দিনের কথাই বলছি। যিনি গ্রাম সাংবাদিকতার পথিকৃত কিংবা চারণ সাংবাদিক হিসেবে খ্যাত।
‘দাড়িতে মৌচাক’ শিরোনামে তাঁর লেখা খবরটি সঠিক ছিল না। লোকমুখে শোনা তথ্য দিয়ে লেখা। চমক খবর। লুফে নিল সেকালের জনপ্রিয় দৈনিক আজাদ। হইচই পড়ে গেল মিডিয়া পাড়ায়। যারা খবরটি মিস করেছেন তাদের চাকরি যায় যায় অবস্থা। অনুসন্ধান। আরও খোঁজ। অবশেষে ভুল প্রমাণিত। খবরটি ভুল ছিল। সাংবাদিকতার প্রথম জীবনে সেই থেকে শিখলেন তিনি। লোকমুখে পাওয়া তথ্য, শোনা কথায় আর কোনো খবর নয়। যা কিছু লেখার, লিখতে হবে মাঠে গিয়ে। ভুল তথ্যের বিষয়ে মোনাজাত ভাই তখন থেকেই সতর্ক। ভালো ট্রিটমেন্টের আশায় অযথা সংখ্যা বাড়িয়ে লেখার প্রবণতা তাঁর মাঝে ছিল না। মানুষ যা বলেছে, প্রমাণাদি যা স্থির করছে, মাঠে যা পাওয়া গেছে— তা দিয়েই খবর। তাঁর সেই আদর্শ আজও আমাদের শেখায়। আজও আমরা শিখি তাঁর কাছ থেকে।
আজ ২৯ ডিসেম্বর গ্রাম সাংবাদিকতার পথিকৃৎ চারণ সাংবাদিক মোনাজাতউদ্দিনের ২৪তম প্রয়াণ দিবস। ১৯৯৫ সালের এই দিনে যমুনার বুকে ফেরির ছাদ থেকে পড়ে গিয়ে তিনি অকালে প্রাণ হারান। খবর সংগ্রহ করতে গিয়ে নিজেই হয়ে যান খবরের শিরোনাম। হাজারো অনুসারীকে শুধু শোকের সাগরে ভাসিয়ে যাননি; বলা চলে এতিম করে গেছেন। ২৪ বছর আগের সেই দিনটির কথা মনে এলে আজও চোখ ভিজে ওঠে। দেশের দক্ষিণেই মোনাজাত ভাইয়ের মৃত্যুর শোক ছিল অনেক বেশি ভারাক্রান্ত। উত্তরে, যেখানে মোনাজাত ভাইয়ের কর্মক্ষেত্র, সেখানে তো শহর-জনপদ স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিল। তাঁর অকাল প্রয়াণের খবরটা কেউ মেনে নিতে পারেনি। তবুও খবরটা এমনই; যা আমরা সকলেই মেনে নিতে বাধ্য হই। নিয়তির কাছে আমরা সকলেই নতজানু।
ব্যক্তিগতভাবে আমি মোনাজাত ভাইকে অনুসরণ করি সেই ছোটবেলা থেকে। সাংবাদিকতায় প্রবল ঝোঁক থেকে নিজের ভেতরে হঠাৎই গড়ে উঠেছিল মোনাজাতচর্চা। নিজের পত্রিকা কেনার সামর্থ্য গড়ে ওঠেনি তখন। অন্য গ্রাহকের কাছে গিয়ে দৈনিক সংবাদ-এর পুরানো কপি সংগ্রহ করে মোনাজাত ভাইয়ের লেখাগুলো পড়তাম। শুধু পড়তামই না, লেখাগুলো কেটে আমার পুরানো খাতায় পেষ্টিং করে রাখতাম। সেগুলো বার বার পড়তাম। ছোটবেলার সেই মোনাজাতচর্চা অব্যাহত আছে আজও। তবে এখন চর্চার ক্ষেত্র একটু ভিন্ন। প্রয়াণের পর মোনাজাত ভাইয়ের নতুন লেখা পাওয়ার সুযোগ নেই। তাই এখন চর্চার মাধ্যম তাঁর পুরানো লেখা, পুরানো বই। একখানা বই আমার লেখার টেবিলে থাকে। ব্যাগেও থাকে। অবসরে বার বার পড়ি। মোনাজাত ভাইয়ের বাক্য গঠন, শব্দ চয়ন, লেখার থিম, গভীরতা আমাকে যেন প্রতিনিয়তই পথ দেখায়। তিনি আমার কাছে আছেন আমার চিরকালীন শিক্ষক হয়ে।
তিনি সাংবাদিক, তিনি সাংবাদিকতার শিক্ষক। শুধু গ্রামের সাংবাদিক নয়, সকল স্তরের সাংবাদিকদেরই শেখার রয়েছে তাঁর কাছ থেকে। মোনাজাতউদ্দিনের শব্দ চয়ন, বাক্য গঠন, সংবাদ-নির্মাণের পরিকল্পনা, এমনকি তথ্য সংগ্রহের কৌশল— সবকিছু থেকেই আমরা প্রতিনিয়ত শিখছি। শব্দ এবং বাক্যের ব্যবহার পাঠককে ঘটনার কাছে নিয়ে যেতো। কোনো মানুষ সম্পর্কে বলতে গেলে মূল বিষয়ে বাইরে অসাধারণ একটা বিবরণ থাকতো, যাতে পাঠক সংবাদ পড়তে আগ্রহী হতেন। তাঁর সংবাদে ব্যবহৃত কিছু শব্দ যেন চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়। কিছু শব্দ-বাক্য সংবাদকে করে তোলে আরও আকর্ষণীয়। লেখাতেই ফুটে ওঠে কতটা গভীর উপলব্ধি দিয়ে দেখেছেন তিনি। এখানেই দেখার চোখের বিশেষত্ব। সাধারণভাবে আমরা চোখ দিয়ে দেখি। দেখার চোখ আমাদের নেই বললেই চলে। আর এখনকার সাংবাদিকতায় দেখার চোখের খুব বেশি প্রয়োজন আছে বলেও মনে হয় না। গণমাধ্যম চায় তরতাজা গরম খবর। এর অধিকাংশই চলমান ঘটনা নির্ভর। দেখার চোখ দিয়ে দেখার সময় কোথায়?
গ্রাম সমাজের আসল চেহারা পাঠকের সামনে তুলে এনে বাংলাদেশের সাংবাদিকতায় এক ভিন্নধারা যুক্ত করেছেন মোনাজাতউদ্দিন। কঠোর পরিশ্রম, প্রতিনিয়ত প্রতিকূলতা অতিক্রমের ভেতর দিয়ে সারাক্ষণ কাজের মনোনিবেশ করেছেন তিনি। গ্রামীণ সমাজ-জীবনের অভ্যন্তরের ক্ষত তুলে ধরেছেন শহরের চশমা আঁটা পাঠকের সামনে। প্রশাসনের ঘাপলা, সরকারি বরাদ্দ বিতরণে অনিয়ম, সুবিধাভোগীর দাপট, ভূমিহীন মানুষের জীবনের লড়াই, খেয়ে-না খেয়ে জীবন অতিবাহিত করা মানুষের অধিকার-সবই নিপুণ দক্ষতায় তুলে এনেছেন খবরে। তৎকালীন সংবাদের পাঠকেরা তাঁর একটি খবরের জন্য অপেক্ষা করতেন। পাঠকের চিন্তায় কাজ করতো, কাল সকালে মোনাজাতউদ্দিন নতুন কী নিয়ে আসছেন! শুধু সংবাদ লেখার মধ্যেই তিনি সীমাবদ্ধ থাকতেন না। সংবাদের পেছনের গল্পগুলোও তিনি জানাতেন পাঠকদের। এক একটি সংবাদ তৈরির পেছনেও যেন রয়েছে বড় বড় গল্প। দিনের পর দিন অপেক্ষা একটি নতুন তথ্যের জন্যে। মোনাজাতউদ্দিনের লেখা ‘সংবাদ নেপথ্য’ ও ‘পথ থেকে পথে’ বাইয়ে এমন অনেক গল্পের বিবরণ রয়েছে। সংবাদ সংগ্রহে কতটা কৌশলী হওয়া যায়, কত ধরণের বিকল্প অবলম্বন করা যায়, তা আমরা জানতে পারি এইসব বই থেকে।
পেশাগত জীবনে সত্য প্রকাশে কখনো আপোস করেননি মোনাজাতউদ্দিন। কোনো ঘটনা ঘটলে, তা যার বিরুদ্ধেই হোক না কেন, প্রকাশ করতেই হবে। সরকারি বরাদ্দ, ত্রাণ বিতরণে অনিয়মের খবর, কালোবাজারির খবর লিখতে গিয়ে কোনো পরিচিতজনের বিরুদ্ধেই হয়তো কলম ধরতে হয়েছে। যেভাবেই হোক, কৌশলে সেই সংবাদ প্রকাশ করেছেন। কখনো সংবাদ প্রকাশের পর নিজেই কোথাও লুকিয়ে থাকতেন। কিন্তু সত্য প্রকাশে কোনো কার্পণ্য করেননি। শত বাঁধা অতিক্রম করেও সত্যের সন্ধানে ছুটেছেন অবিরাম। নিজের পত্রিকার অর্থায়নকারীর বিরুদ্ধে খবর লিখতেও তাঁর হাত কাঁপেনি। ১৯৭২ সালে রংপুর থেকে প্রকাশিত ‘দৈনিক রংপুর’-এর সম্পাদক ও প্রকাশক ছিলেন মোনাজাতউদ্দিন। পাবনার এক ব্যবসায়ী এই পত্রিকার অর্থ-জোগানদাতা। কয়েকজন তরুণ রিপোর্টার নিয়ে চলছিল এই পত্রিকা। প্রকাশের পর থেকেই তরতাজা খবরে হটকেকের মতো বিক্রি হতে লাগলো পত্রিকাটি। একবার কালোবাজারিদের ৮০ বস্তা চিনি গায়েবের খবর এলো। পত্রিকার অর্থ-জোগানদাতা ব্যক্তিটি নিজেই চিনি গায়েবের হোতা। মোনাজাতউদ্দিন নিজেই অতি কৌশলে এই খবরটি তৈরি করেছিলেন। গভীর রাতে যখন পত্রিকায় খবর ছাপা হচ্ছে তখন প্রেসে হাজির অর্থ-জোগানদাতা নিজেই। এসে বলেন, ‘আমার টাকায় পত্রিকা বেরোয়, সেই পত্রিকায় আমারই বিরুদ্ধে খবর ছাপা হবে? আপনি পাগল নাকি?’ জবাবে মোনাজাতউদ্দিন বলেছিলেন, ‘শান্ত হোন। এ খবর ছাপা হবে। ঘটনা সত্য। আমি নিজে লিখেছি।’ খবরটি চাপা দেওয়ার জন্য অর্থ-জোগানদাতা প্রথমে রাগান্বিত হন। পরে নরম সুরে অনুরোধ করেন। এক পর্যায়ে টাকার প্রস্তাব দিয়ে বসেন। এক হাজার, দুই হাজার। কিন্তু মোনাজাতউদ্দিন অনড়। শেষ পর্যন্ত মেয়ের দিব্যি দেওয়ার পর মোনাজাতউদ্দিন আবেগতাড়িত হয়ে মেশিনম্যানকে ম্যাটার নামাতে বলেন।
খবরের গভীর অনুসন্ধান, অতি সহজ-সরল উপস্থাপন, পাঠকের বোধগম্য শব্দ আর বাক্য গঠণে বিশেষ পারদর্শিতায় মোনাজাতউদ্দিনের ঠাঁই হয়েছে পাঠক মনে। শুধু চোখের দেখা নয়, দেখার চোখ দিয়ে দেখেছেন তিনি। উপলব্ধি করেছেন অতি দরদ দিয়ে। আর তাই তাঁর নিবিড় শব্দ-বুনন পাঠকের হৃদয় ছুঁয়েছে। তাঁর বলপয়েন্টের ডগা থেকে নিউজপ্রিন্ট কাগজে এক একটি সংবাদ জীবন্ত হয়ে উঠত। আবার খবরের চরিত্রের সঙ্গে দেখেছি মোনাজাত ভাইয়ের নিবিড় সখ্যতা। ১৯৭৭ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি দৈনিক সংবাদ-এ তখনকার কিশোর আহসান হাবিবের স্বপ্নের গল্পটি উঠে এসেছিল মোনাজাতউদ্দিনের ‘উত্তরের পাঁচালী’ সিরিজে। এতে মোনাজাতউদ্দিন লিখেছিলেন, ‘‘জয়পুরহাট শহরে দেখা উজ্জল মুখ কিশোর আহসান হাবীবের সাথে। সতেরো বছর বয়সের হাবীব পাঁচবিবি উচাই হাইস্কুল থেকে এবার এসএসসি পরীক্ষা দেবে। ওর বাবা ইউনিয়ন পরিষদ অফিসের সেক্রেটরি। হাবীবকে বলেছিলাম, তোমার সমস্যা তোমাকেই সমাধান করতে হবে। তোমার মত তরুণ যুবকদের দিকেই তো তাকিয়ে আছে দেশ। গ্রামের মানুষের ভাগ্য উন্নয়নে এগিয়ে এসো। হাবীব চঞ্চল হলো। অনেক কথা যেন একসাথে সে বলতে চায়। পারলো না।’’ আমার সঙ্গে দেখা হয়েছিলো আহসান হাবীবের। তরুণ বয়সে মোনাজাতউদ্দিনকে দেওয়া প্রতিশ্রুতি রাখতে পারেননি হাবীব। চোখের জল মুছতে মুছতে তিনি বলেন, ‘আমি সে কথা রাখতে পারিনি। এই সমাজ আমার প্রতিজ্ঞা রক্ষা করতে দেয়নি।’
গ্রামের মানুষের প্রাত্যহিক জীবনযাপন থেকে শুরু করে অর্থনীতি, ব্যবসা-বাণিজ্য, বেকার যুবকদের অবস্থা, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, রাস্তাঘাট, উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে দুর্নীতি সব বিষয়ে কলম ধরেছেন মোনাজাতউদ্দিন। শুধু যে অফিসের এসাইনমেন্ট করেছেন তা নয়, প্রতিবেদন লেখার জন্য নিজেরই একটা পরিকল্পনা থাকতো। অফিসের এসাইনমেন্ট অনুযায়ী সংবাদ প্রতিবেদন লেখার পর তিনি নিজের পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ করতেন। আর অফিস থেকে কোনো প্রতিবেদন কিংবা ছবি চেয়ে পাঠালে তা কখনোই মিস করতেন না মোনাজাতউদ্দিন। খবর সংগ্রহ, লেখা এবং প্রেরণের ক্ষেত্রে মোনাজাতউদ্দিনের অভিধানে ‘না’ শব্দটি ছিল না। এবং এটাই ছিলো তার সাংবাদিকতার চ্যালেঞ্জ। তাঁর সাথে অন্যান্য পত্রিকায় কর্মরত সাংবাদিকেরা না পারলেও তাঁকে পারতেই হবে। সাংবাদিকতা জীবনে বহুবার অনেক সংকটের মধ্যেও ঝুঁকি নিয়ে বার্তাকক্ষে খবরের প্যাকেট পৌঁছে দিয়েছেন। তাই তো মোনাজাতউদ্দিনের মুখেই এমন কথা শোভা পায় ‘কোন এসাইনমেন্টে আমি জীবনে কখনো ব্যর্থ হইনি।’
প্রতিবেদন তৈরিতে পূর্ব-পরিকল্পনা যে কতটা জরুরি, তা মোনাজাতউদ্দিনের প্রতিবেদনগুলো পড়লে সহজেই অনুমান করা যায়। গ্রামীণ সাংবাদিকতার পথিকৃত এই সাংবাদিকের প্রতিবেদন পরিকল্পনা ছিল গুরুত্বপূর্ণ কাজ। এই পরিকল্পনায় আগেই ঠিক করে নিতেন তার কী চাই? কোন বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ করা হবে, কোথায় সরেজমিনে যেতে হবে, কাদের সাক্ষাৎকার নেওয়া হবে, কী কী ছবি লাগবে, সবকিছুই থাকতো এসব পরিকল্পনায়। আবার কোন কোন প্রতিবেদন তৈরির জন্য পরিকল্পনার আগেও মাঠ ঘুরে আসতেন, যাতে পরিকল্পনাটা সঠিকভাবে করা যায়। এভাবে কঠোর প্ররিশ্রমে নির্মিত হয়েছে এক একটি শক্তিশালী অনুসন্ধানী প্রতিবেদন।
নগর সাংবাদিকতাকে টেক্কা দিয়ে গ্রাম-সাংবাদিকতাকে নগরে পৌঁছে দিয়েছেন মোনাজাতউদ্দিন। তিনি দেখিয়েছেন শহরের চেয়েও অনেক বড় খবর থাকতে পারে প্রত্যন্ত গ্রামে। গ্রামীণ খবরের শেকড়ে দৃষ্টি ছিল তাঁর। আর কোনোভাবেই সেটা একদিনে হয়নি। প্রতিটি খবরের পেছনে তিনি সময় ও শ্রম ব্যয় করেছেন প্রচুর। উত্তরবঙ্গের বেশকিছু গ্রামের ওপর সিরিজ প্রতিবেদন লিখেছেন তিনি। আবার সেগুলোর ফলোআপও করেছেন। ছোট ছোট খবর; কিন্তু খুবই ধারালো। গ্রামের খবর অনুসন্ধানে গেলে মোনাজাতউদ্দিনের সামনে থেকে কোনোকিছুই এড়িয়ে যেতে পারেনি। নিখুঁত দৃষ্টিতে খুঁটিনাটি সব বিষয় উঠে এসেছে তার প্রতিবেদনে। এই গ্রামের প্রতিবেদন তৈরির ক্ষেত্রেও তা ছিলো। আবার ফলোআপ প্রতিবেদনের ক্ষেত্রেও একইভাবে পরিকল্পনা করতেন।
মোনাজাতউদ্দিনের জন্ম ১৯৪৫ সালের ১৮ জানুয়ারি রংপুরের গঙ্গাচড়ার হারাগাছের মরনিয়া গ্রামে। বাবা মৌলভী আলিমউদ্দিন আহমদ; আর মা মতিজান নেছা। স্ত্রী নাসিমা আখতার ইতি। তিন ছেলেমেয়ের বাবা ছিলেন মোনাজাতউদ্দিন। দুই মেয়ে চৈতী আর সিঁথি ডাক্তার। আর একমাত্র ছেলে সুবর্ণ বুয়েটে অধ্যয়নকালে প্রাণ হারিয়েছেন। খবর সংগ্রহের নেশায় উত্তরের পথ থেকে পথে ছুটেছেন মোনাজাতউদ্দিন। একনিষ্ঠতা, একাগ্রতা আর কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে প্রতিদিনই পাঠকের সামনে হাজির হয়েছেন নতুন নতুন বিষয় নিয়ে। ছোটবেলা থেকে সংগঠন করার ঝোঁক ছিলো চারণ সাংবাদিক মোনাজাতউদ্দিনের। ১৯৬২ সালে ঢাকা থেকে প্রকাশিত ‘দৈনিক আওয়াজ’-এর স্থানীয় সংবাদদাতা হিসাবে কাজ শুরু করেন। ১৯৬৬ সালে উত্তরাঞ্চলের সংবাদ প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করেন ‘দৈনিক আজাদ’-এ। দেশ স্বাধীনের পর ১৯৭২ সালে নিজের সম্পাদনায় রংপুর থেকে বের করেন ‘দৈনিক রংপুর’। এক সময় ‘দৈনিক পূর্বদেশ’-এ কাজ করেছেন। ১৯৭৬ সালে ‘দৈনিক সংবাদ’-এর উত্তরাঞ্চলীয় প্রতিনিধি হিসেবে নিয়োগ পান তিনি। টানা কুড়ি বছর সেখানেই কাজ করেন। ৪ জুন ১৯৭৬ তারিখে ‘দৈনিক সংবাদ’ থেকে পাওয়া নিয়োগপত্রে উত্তরাঞ্চলীয় স্টাফ রিপোর্টার হিসেবে মোনাজাতউদ্দিনের বেতন ছিলো মাত্র ৫০০ টাকা। ১৯৯৫ সালের ২৪ এপ্রিল তিনি ‘দৈনিক জনকণ্ঠ’-এ সিনিয়র রিপোর্টার হিসেবে যোগ দেন। একই বছর ২৯ ডিসেম্বর মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি সেখানেই কর্মরত ছিলেন। শুধু সংবাদ লেখায় নয়, তাঁর সৃজনশীলতা প্রকাশ পেয়েছে পত্রিকার প্রচ্ছদ অংকনে, কবিতা-ছড়া লেখায়, নাটক লেখায়। কাজের স্বীকৃতি হিসেবে পেয়েছেন অসংখ্য পুরস্কার।
হতাশার খবর, মোনাজাতউদ্দিনকে নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরতে কোনো উদ্যোগই চোখে পড়ে না। আর সে কারণেই আলাপ প্রসঙ্গে কারো কারো মুখে শুনি- ‘‘ও হ্যাঁ, ‘মোনতাজ উদ্দিন’ নামে একজন সাংবাদিকের নাম শুনেছিলাম।’’ ‘মোনাজাতউদ্দিন’ শব্দটাকে কেউ যখন ‘মোনতাজ উদ্দিন’ বলে; তখন বুকটা কষ্টে ভরে ওঠে। তরুণ প্রজন্মের কাছে মোনাজাত ভাইকে তুলে ধরতে ২০১৬ সাল থেকে আমার কাজের ক্ষেত্র উপকূল অঞ্চলে মোনাজাতউদ্দিন প্রয়াণ দিবস পালনের উদ্যোগ নেই। সেই ধারা এখনও চলছে। তাঁকে স্মরণের মধ্যদিয়েই আমরা তাঁর আদর্শ, তাঁর চিন্তাভাবনার প্রতিফলন ঘটাতে পারি। মোনাজাত ভাই, আমরা জেগে আছি, তুমি ঘুমাও উত্তরের মাটিতে।