হাত,পা ছাড়াই মুখ দিয়ে লিখে গ্র্যাজুয়েট পাশ
বিশেষ প্রতিবেদন :
হাত,পা ছাড়াই মুখে লিখে গ্র্যাজুয়েট পাশ করেন মো. হাফিজুর রহমান। তিনি হুইল চেয়ারে চলাফেরা করেন। হুইল চেয়ারই তার চলফেরা একমাত্র ভরসা।
মো. হাফিজুর রহমান বলেন, প্রায় ছোট বেলা থেকে সবাই বলত আমি কিছু করতে পারবো না। পড়ালেখা তো নয়ই। কিন্তু আমি হাল ছাড়িনি। আমি হাত,পা ছাড়া একজন প্রতিবন্ধী মানুষ। আমি হাত,পা ছাড়াই মুখ দিয়ে লিখে মার্স্টাস পাশ করেছি। আমি সবাইকে দেখিয়ে দিয়েছি চেষ্টা আর মনোবল থাকলে সবই সম্ভব।
তিনি আরও জানান, সম্পূর্ণ নিজের প্রচেষ্টায় কোনো প্রকার কোচিং ছাড়াই ২০১২ থেকে ১৩ শিক্ষাবর্ষে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে মেধাতালিকায় উত্তীর্ণ হই। এরপর সেখানে ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগে ভর্তি হয়ে জীবনের মোড় ঘুরে গেল। পরীক্ষার হলে মেঝেতে পাটি বিছিয়ে বসে ছোট টুলে খাতা রেখে মুখ দিয়ে লিখে পরীক্ষা দিয়েছি। এভাবেই ধীরে ধীরে হাফিজুর উত্তীর্ণ হন অনার্স এবং মাস্টার্সে। অনার্সে সিজিপিএ-৪ এর মধ্যে পেয়েছেন জিপিএ ৩ দশমিক ১। মাস্টার্সে পেয়েছেন জিপিএ-৩ দশমিক ৬।
তবে তার এই দীর্ঘ পথচলা মোটেও মসৃণ ছিল না। কীভাবে নিজের পড়াশোনা, থাকা-খাওয়ার খরচ মেটাবেন তা নিয়ে মাথায় চিন্তার পাহাড় নেমে পড়ে। বাড়িতেও সহযোগিতা করার দায়িত্ব ছিল কাঁধে। কারণ চার ভাইয়ের মধ্যে বাকিরা সবাই বিয়ে করে তাদের পরিবার নিয়ে ব্যস্ত। কেউ বাবা-মাকে সাহায্য করার ছিল না।
প্রতিবন্ধী হয়েও মনের শক্তিতে দুর্বল না হয়ে হুইল চেয়ারে বসে ব্যবসা করেন হাফিজুর। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগিতায় ক্যাম্পাসের মূল ফটকের পাশে বিশ্ববিদ্যালয়ের লোগো সংবলিত ব্যাগ, টি-শার্ট, হুডি, ব্যাজ বিক্রি শুরু করেন তিনি। সঙ্গে নিজ জেলা বগুড়ার দইও বিক্রয় করেন।
হাফিজুর জানান, আমার দুই পা অক্ষম। কোনো শক্তি নেই। পা দিয়ে কোনো কাজই করা সম্ভব নয়। হাতও অসাড়, অনেক কষ্টে হুইল চেয়ারটি চালাতে হয়। কারো সাহায্য ছাড়াই আমি এটি চালাতে পারি। এদিকে, ২০০৮ সালের ২১ অক্টোবর কাজ করার সময় দুর্ঘটনাজনিত কারণে তার মেরুদণ্ডের হাড় ভেঙ্গে যায়। এজন্য সিঙ্গাপুরে দুই মাস চিকিৎসাধীন ছিলেন।
১১ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম সমাবর্তনের আমেজ ছুঁয়ে যায় হাফিজুরের মাঝেও। ক্যাম্পাসের অন্যান্য গ্র্যাজুয়েটদের মতো ঘুরে বেড়িয়েছেন তিনিও। তবে তার হুইল চেয়ারটি নিয়ে। প্রথম সমাবর্তনে তিনিও রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদের উপস্থিতিতে সার্টিফিকেট গ্রহণ করেন। জন্ম থেকেই বিকলাঙ্গ হাফিজুর ক্যাম্পাসের মূল ফটকের পাশে হুইলচেয়ারে বসে অপলক দৃষ্টিতে দেখছিলেন সবাইকে।
১৯৯৩ সালে বগুড়া জেলার ধুনট থানার বেলকুচি গ্রামে জন্ম নেন হাফিজুর। বাবা মফিজ উদ্দিন একজন কৃষক। মা ফিরোজা বেগম গৃহিণী। চার ভাইয়ের মধ্যে সবার ছোট তিনি। জন্ম থেকেই হাফিজুরের হাত ও পা অসাড়। ২০০৯ সালে মানবিক বিভাগ থেকে এসএসসি পরীক্ষায় জিপিএ ৪ দশমিক ১৯ পেয়ে উত্তীর্ণ হন। পরে ধুনট ডিগ্রি কলেজ থেকে ২০১১ সালে এইচএসসিতে পান জিপিএ ৩ দশমিক ৬০। সুশিক্ষিত হওয়ার প্রয়াস নিয়ে উচ্চশিক্ষার জন্য এরপর ঢাকায় পাড়ি জমায় এই তরুণ।
পরিচিতজনরা ছাড়াও অনেকে তাকে সমাবর্তনের গাউন, ক্যাপ পরা দেখে এগিয়ে আসছেন ছবি তুলতে, কুশলবিনিময় করতে। প্রথমবারের মতো সমাবর্তনকে ঘিরে গ্র্যাজুয়েটদের পদচারণায় মুখর দিনটি প্রিয় ক্যাম্পাসে হাফিজুরও নিজের মতো করে কাটিয়েছেন। সবার সহযোগিতা ও নিজের যোগ্যতা দিয়ে পাড়ি জমাতে চান আরো অনেক পথ।
এত সংগ্রামের মাঝেও উচ্চ শিক্ষিত হাফিজুর স্বপ্ন দেখেন একটি ভালো সরকারি চাকরির। এজন্য নিজেকে প্রস্তুতও করছেন। তবে কতটুকু এগুতে পারবেন তা নিয়ে সংশয় আছে। কারণ অতীতে অনেকের সহযোগিতা পেলেও ধীরে ধীরে কেউ কেউ হাত গুটিয়ে নিয়েছেন। আবার নিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক দফতরে সেকশন অফিসারের পদের জন্য আবেদন জানালেও প্রশাসনের পক্ষ থেকে কোনো সাড়া মেলেনি। মাঝে প্রধানমন্ত্রীর কাছেও নিজের জীবন সংগ্রামের কথা তুলে ধরে দীর্ঘ চিঠি দিয়েছিলেন সেখান থেকেও কোনো সাড়া মেলেনি।
খোলাডাক/ সংকলিত