বাবার ভুলে প্রাণ দিয়েছিলেন লক্ষ্মীন্দর
বাংলা সাহিত্যের সর্বকালের শ্রেষ্ঠ লোককাহিনীগুলোর একটি হচ্ছে বেহুলা লক্ষ্মীন্দরের গল্প। প্রাচীন মনসামঙ্গল কাব্যে এর প্রথম সন্ধান পাওয়া যায়।
তাদের প্রেম কাহিনী বাংলার মানুষের কাছে অত্যন্ত জনপ্রিয়। মানুষ আজও অবসর সময়ে গল্প-আড্ডায় এই অমর প্রেম কাহিনী রোমন্থন করে। কেউ কেউ গল্পটি অনেকবার শোনা সত্বেও আবার নতুন করে শুনতে চায়।
কিছু গল্প থাকে যা কখনো পুরোনো হয় না এবং যা শুনে মানুষ কখনো ক্লান্ত হয় না, বেহুলা লক্ষ্মীন্দরের গল্পটিও তেমন একটি অমর গল্প।
বেহুলা লক্ষ্মীন্দরের গল্পটি জানতে হলে আগে জানতে হবে দেবলোকের কাহিনি সম্পর্কে। ভগবান শিবের মেয়ে ছিলেন দেবী মনসা। পৃথিবীর মানুষ তখন ভগবান শিবকে শ্রদ্ধা এবং তার উপাসনা করতেন। কিন্তু সর্পদেবী হওয়া সত্বেও কেউ দেবী মনসার উপাসনা করত না। এতে করে তার দেবীত্ব নিয়ে প্রশ্ন উঠলো।
এমতাবস্থায় শিব তার মেয়েকে একটি সমাধান দিলেন। যদি কোনো ‘শৈব’ ভক্ত মনসার উপাসনা করতে রাজি হয় তাহলেই পৃথিবীতে তার উপাসনা করা হবে। যারা ভগবান শিবের উপাসনা করতেন তাদের ‘শৈব’ বলা হয়।
চম্পকনগর অঞ্চলের চাঁদ সওদাগর ছিলেন শিবের একজন ভক্ত এবং লক্ষ্মীন্দরের বাবা। দেবী মনসা তাকে তার উপাসনার জন্য বাছাই করেন, কিন্তু চাঁদ সওদাগর তার পূজা করতে অস্বীকার করেন এবং বলেন, যে কিনা ভগবান শিবের উপাসনা করে সে করবে সামান্য এক সাপের দেবীর উপাসনা।
এটা শুনে দেবী রুষ্ট হয়ে যান এবং ক্ষুব্ধ হয়ে বিভিন্ন ভাবে তার ক্ষতি করতে শুরু করেন। সে যতবার তার উপাসনা লাভের চেস্টা করে প্রতিবারই ব্যর্থ হয়। কারন চাঁদ সওদাগর ভগবান শিবের একটি মন্ত্র জানতো যার কারনে সে প্রতিবার দেবীর সকল প্রতারনার প্রতিকার করতে পারতো।
এক পর্যায়ে যখন মনসা দেখলো যে কোনোভাবেই সওদাগরের ক্ষতি করা যাচ্ছেনা তখন সে অর্ধ-নগ্নাবস্থায় অন্য এক নারীর রূপ ধারন করে তার কাছে আসলো।
যখন চাঁদ সওদাগর তাকে স্পর্শ করতে চাইলো তখন মনসা তাকে বললো বিশেষ সেই মন্ত্রটি বলতে। চাঁদ সওদাগর তাকে মন্ত্রটি বলে দিলো। তখন মনসা তার আসল রূপ ধারন করলো এবং তার উপাসনা করতে বললো। ওই মুহূর্তে মন্ত্রটি আর চাঁদ সওদাগরের কাছে ছিলোনা মন্ত্রটি মনসার কাছে চলে গিয়েছিলো।
শঙ্কর নামে চাঁদ সওদাগরের একজন বন্ধু ছিলো যে নিজেও তন্ত্র-মন্ত্র জানতো। নিজের ঐশ্বরিক মন্ত্র হারিয়ে চাঁদ তার বন্ধু শঙ্করের কাছে সাহায্য চাইলো কিন্তু শঙ্করের মন্ত্র বেশিক্ষন টিকতে পারেনি কারন মনসা তাকে আরো শক্তিশালী একটি মন্ত্রের সাহায্যে মেরে ফেললো। সওদাগর আবার অসহায় হয়ে পড়লো, কিন্তু তবু সে মনসার উপাসনা করতে রাজি হলো না।
এতে আরো ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে মনসা। শ্রীলঙ্কায় বাণিজ্যে যাওয়ার পথে কালীদহের সাগরে আচমকা ঝড় সৃষ্টি করে মনসা। এতে চাঁদ সওদাগরের সপ্তডিঙা বহর ডুবে যায়। মারা যায় তার ৬ পুত্র। পুড়ে যায় বসতবাড়িও।
এমনভাবে প্রতিক্ষেত্রে অবিচার হওয়াতে চাঁদ সওদাগর তার সবকিছু হারালো এবং পথে বসলো কিন্তু তবুও সে শিবের উপাসনা ছেড়ে সাপের উপাসনা করলো না।
ব্যবসায় এসব ক্ষতির সম্মুখীন হয়ে চম্পকনগর ফেরার পথে চাঁদ সওদাগরের লক্ষীন্দার নামে একটি সন্তানের জন্ম হলো। একই সময়ে তার ব্যবসায়ীক সতীর্থ সাহার কন্যা বেহুলাও জন্ম নিলো। তখনকার একটি গুজব খুব জনপ্রিয় ছিলো যে, যখন মনসা যখন দেখলো কোনোভাবেই সওদাগরকে উপাসনার জন্য রাজি করানো যাচ্ছেনা তখন সে স্বর্গ থেকে দুই’জন নর্তকীর সাহায্য চাইলো এবং তারা কথা দিলো যে, পৃথিবীতে তারা বেহুলা এবং লক্ষ্মীন্দর নামে জন্ম নিবে এবং তখন সওদাগর মনসার উপাসনা করবে।
উভয় ছেলেমেয়েই একসঙ্গে বেড়ে উঠতে লাগলো। অন্যদিকে মনসার কাছে সাপ ছিলো যা দিয়ে সে চাঁদ সওদাগরের সব সন্তানদের মেরে ফেলতে পারবে যদি তার উপাসনা না করা হয়। বেহুলা লক্ষ্মীন্দরের বাবা-মা তাদের বিয়ে দেয়ার কথা ভাবলো এবং তাদের জাতপত্রিকা গুনিয়ে দেখলো। জাতপত্রিকা গুনিয়ে দেখতে গিয়ে তারা জানতে পারলো যে লক্ষ্মীন্দরকে বিয়ের রাতেই সাপে কামড়াবে, তবে বেহুলা কখনো বিধবা হবেনা। এছাড়া তারা উভয়ই মনসার উপাসনা করতো, সুতরাং মনসা হয়ত তাদের কোনো ক্ষতি করবেনা এই বিশ্বাসে তাদের বিয়ে দেয়া হলো।
কিন্তু তবুও ভয় ছিলো যে মনসা আগেও তার ছয় সন্তানকে মেরেছে, তাহলে নিশ্চয়তা কি যে একেও মারবেনা। এটা ভেবে চাঁদ সওদাগর লক্ষ্মীন্দরের একটু বেশি খেয়াল রাখতে শুরু করলো। সে ঠিক করলো বেহুলা লক্ষ্মীন্দরের বাসর ঘরের জন্য একটি দুর্ভ্যেদ্য লোহার দেয়াল তৈরি করবে। যে দেয়ালে কোনো সামান্যতম ছিদ্রও থাকবেনা যা থেকে সাপ প্রবেশ করতে পারে।
কিন্তু সেখানেও ভুল ছিলো। বিশ্বকর্ম নামক একজন দক্ষ কারিগর লোহার দেয়ালটি বানায়। দেবী মনসার দাবিতে সে লোহার দেয়ালে একটি ছিদ্র রেখে দেয়। এটাও বলা হয়ে থাকে যে মনসা দেবীর ধমক দেয়ায় সে এই কাজটি করতে বাধ্য হয় তা না হলে মনসা তার পরিবারকে সাপের বিষে মেরে ফেলার ভয় দেখায়। অবশেষে সেই কাংখিত দিন আসলো।
বিয়ের রাতে দেবী মনসা কালনাগিনীকে সেই লোহার তৈরী কক্ষে পাঠায়। তার সব সাপের মধ্যে কালনাগিনী হল সবচাইতে বেশি বিষধর সাপ। বেহুলা সারা রাত জেগে তার স্বামীকে পাহারা দেবে বলে ঠিক করে কিন্তু মনসা তার শক্তিশালী মন্ত্র দ্বারা তাদের ঘুম পাড়িয়ে দেয়। নাগিনী এসে দেখলো যে যদিও বেহুলা ঘুমিয়ে পড়েছিলো তবু সে তার স্বামীকে এমনভাবে আগলে রেখেছিলো যে তার শরীরের কোনো অংশে কামড়ানোর কোন উপায় ছিলোনা।
তবে সেখানেও কিছু অসাবধানতা ছিল। বেহুলার কোকড়া চুলগুলো বিছানা থেকে নিচের দিকে ঝুলে পড়েছিল, কালনাগিনী সেই চুল বেয়ে উপরে যেয়ে লক্ষ্মীন্দরকে কামড়ে তার প্রাণ নিয়ে নিলো।
বিশ্বাস করা হয়ে থাকে বেহুলার সেই বাসর ঘর বগুড়া সদরের গোকুল নামক স্থানে অবস্থিত। বগুড়া শহর হতে প্রায় ১১ কিলোমিটার উত্তরে এর অবস্থান। ১৯৩৪-১৯৩৬সালে এটি খনন করা হয় এবং সেখানে পুরাতন একটি মন্দির আবিষ্কৃত হয়।
ষষ্ঠ থেকে সপ্তম শতাব্দীর পাল দের সময়ে মাটি খুড়ে এখান থেকে বিভিন্ন পোড়ামাটির ফলক উদ্ধার করা হয়।
এখানে অবস্থিত টিলাটিকেও এরই অংশ হিসেবে মনে করা হয়। এই টিলাটির পূর্ব পাশেই মেধে আরেকটি টিলার সন্ধান পাওয়া যায় যার নাম ‘নেতাই ধোপানির পাত’।
টিলাটি গোকুল গ্রামের পশ্চিম দিকে মহাস্থানগড় থেকে প্রায় ২ কিঃ মিঃ দক্ষিন-পশ্চিমে অবস্থিত। ১৯৩৪-১৯৩৬ এর দিকে এটি খনন করা হয়েছিল এবং এর ভেতরে একটি মন্দিরের পরিত্যক্ত ধ্বংসাবশেষ খুঁজে পাওয়া গিয়েছিলো।
মন্দিরটির মাঝখানে একটি ৫১.২সেঃমিঃ×৪৬.১সেঃমিঃ উচ্চতার একটি পাথরের ফলক পাওয়া যায় যেখানে ১২ টি অগভীর কূপ এবং একটি বিশাল গর্ত ছিলো। গর্তটিতে একটি এক ইঞ্চি বর্গাক্ষেত্রাকার ছোট স্বর্ণ পাওয়া গিয়েছিলো ছিল। পাথরের ফলকটির নিচে এছাড়া চোখে পড়ার মত তেমন আর কিছু পাওয়া যায়নি।
মহাস্থানগড় থেকে গোকুল মেধ ৩ কিঃমিঃ দূরে। একজন ভ্রমনকারী রিক্সা, সি.এন.জি অথবা অটো রিক্সায় করে মহাস্থানগড় থেকে যেতে পারবে।
তৎকালীন সময়ের প্রচলিত প্রথা অনুসারে যারা সাপের দংশনে নিহত হত তাদের সৎকার প্রচলিত পদ্ধতিতে না করে তাদের মৃতদেহ ভেলায় করে নদীতে ভাসিয়ে দেয়া হত এ আশায় যে ব্যক্তিটি হয়ত কোন অলৌকিক পদ্ধতিতে ফিরে আসবে।
প্রথা অনুযায়ী লক্ষ্মীন্দরকেও ভেলায় ভাসিয়ে দেয়া হয়। সাধারনত শুধুমাত্র সর্প দংশন ব্যক্তিকেই ভাসিয়ে দেয়া হতো কিন্তু বেহুলা সবার বাঁধা অগ্রাহ্য করে তার মৃত স্বামীর সাথে ভেলায় চড়ে বসে। মাসের পর মাস এবং গ্রামের পর গ্রাম পাড়ি দিতে থাকে। এই অবস্থায় মৃতদেহ পঁচে যেতে শুরু করে এবং গ্রামবাসীরা তাকে মানসিক ভারসাম্যহীন মনে করতে থাকে। বেহুলা মনসার কাছে প্রার্থনা অব্যাহত রাখে। তবে মনসা ভেলাটিকেই কেবল ভাসিয়ে রাখতে সাহায্য করে।
তারা ছয় মাস ধরে যাত্রা করে এবং একসময় ভেলাটি মনসার পালক মাতা নিতার কাছে আসে তিনি নদীতীরে ধোপার কাজ করার সময় ভেলাটি ভূমি স্পর্শ করে। তিনি মনসার কাছে বেহুলার নিরবচ্ছিন্ন প্রার্থনা দেখে বেহুলাকে তার কাছে স্বর্গে নিয়ে যাবার সিদ্ধান্ত নেন।
তিনি তার ঐশ্বরিক ক্ষমতাবলে চোখের পলকে বেহুলা ও মৃত লক্ষ্মীন্দরকে স্বর্গে পৌছে দেন। মনসা বলেন, বেহুলা তার স্বামীকে ফিরে পাবে কিন্তু তার জন্য তাকে তার শ্বশুর চাঁদ সওদাগরকে দেবী মনসার উপাসনা করার জন্য রাজি করাতে হবে।
বেহুলা জানায় সে তার শ্বশুরকে মনসার উপাসনা করতে রাজি করাবে। এর পরই তার স্বামীর মৃতদেহে জীবন ফিরে আসতে শুরু করে, লক্ষ্মীন্দর তার চোখ মেলে এবং বেহুলার দিকে তাকায়। তার শরীরের ক্ষয়ে যাওয়া মাংস ফিরে আসে। তাদের পথপ্রদর্শক নিতা আবার তাদের পৃথিবীতে পাঠিয়ে দেয়।
পৃথিবীতে পৌছে বেহুলা পুরো ঘটনা খুলে বলে চাঁদ সওদাগর তখন দেবী মনসার উপাসনা করতে আর অসম্মতি জানাতে পারেনা। মনসা তাকে বিভিন্ন ভাবে কষ্ট দিয়েছে যার রাগ সে ভুলতে পারেনা এবং দেবীকে ক্ষমাও করতে পারেনা।
সে দেবীর মূর্তিকে পিছনে ফেলে তার বাম হাতের মাধ্যমে দেবীর উপাসনা করতে শুরু করেন। দেবী মনসা এতেই তুষ্ট হন এবং তার দেবীত্ব পূর্নতা পায়। তখন থেকে পৃথিবীতে দেবী মনসার উপাসনা শুরু হয়।
বাংলার নারীদের ওপর বেহুলা লক্ষ্মীন্দরের এই প্রেমকথা বছরের পর বছর ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করে। বাংলাদেশ এবং পশ্চিম বঙ্গের সকলের কাছে একটি প্রিয় গল্প এটি। এটি স্বামীর প্রতি ভালোবাসার একটি অসাধারন উদাহরন।
বিভিন্ন বিখ্যাত পরিচালকের পরিচালনায় এবং নামি দামি অভিনেতা অভিনেত্রীদের অভিনয়ে এর ওপর বিভিন্ন নাটক, সিনেমা তৈরি করা হয়েছে। গল্পটির প্রভাব বিভিন্ন সাহিত্য,গল্প কথক এবং কবিদের সৃষ্টিতে রয়েছে। এরকম ভালোবাসার উদাহরন কাল্পনিক,পৌরাণিক কাহিনী গুলোতেও বিরল। এমন দুঃসাহসিক প্রেমের গল্প লোক সাধারনের মুখে আজীবন অমর থাকবে।